মিরাজ রহমান
বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটি নাম। একটি ইতিহাস। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই নামটি। বহুমুখী কর্মদক্ষতার অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। একজন মানুষ হিসেবে সকল প্রকার মানবীয় গুণ-ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করার পাশাপাশি একজন মুসলিম হিসেবে তার ইসলামপ্রীতি ছিল অতুলনীয়। আলেম-উলামাদের সাথে সম্পর্ক এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিলো স্বভাবসুলভ। ধর্মকে কখনো তিনি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে নয়, একটি সুন্দর ও আদর্শ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুসলিম হিসেবে শুধু মুসলমানদের সঙ্গে নয়, সকল ধর্মের সকল মানুষের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখেছেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন কিছু ইসলামপ্রীতির দূর্লভ ছবি ও ইতিহাস নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন ধর্মে কর্মে বঙ্গবন্ধু- কিছু ছবি ও চেপে রাখা ইতিহাস। আসুন তাহলে আর দেরি না করে সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেই বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রীতির কিছু ইতিহাস এবং দেখে নেই কিছু দূর্ভল ছবি।
১. মওলানা ভাসানীকে পিতাতুল্য মনে করতেন বঙ্গবন্ধু- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে পিতাতুল্য মনে করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্টপ্রতি হওয়ার পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মওলানা ভাসানী ছিলেন পিতার মতো। বঙ্গবন্ধুকেও তিনি পুত্রসম স্নেহ করতেন। উল্লেখ্য মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালেই বঙ্গবন্ধু তার সাধারণ সম্পাদক হয়ে ছিলেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি একজন রাজনৈতিক গুরু হিসেবে যতটা মানতেন ঠিক ততটাই তাকে একজন ধর্মীয় পথ-নির্দেশক হিসেবে মান্য করতেন।
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায়ই কোনো নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই শুধুমাত্র গাড়ির ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মওলানার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। সে খবর তৎকালীন আওয়ামীলীগের অনেক নেতাই জানতেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। তখন মওলানা ভাসানী খুবই কেঁদেছেন। তিনি ওইদিন বার বার বলেছেন ‘সব শেষ হয়ে গেল’। তিনি এতো দুঃখ পেয়েছিলেন যে, ঐদিন কোনো কিছুই খাননি, কারো সাথে সাক্ষাৎও করেননি।
২. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি মাওলানা তর্কবাগীশ হবেন- ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ শহীদ মিনারের সমাবেশে মাওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ একসাথে বসে আছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো আরো একজন মাওলানার সাথে গুরু-শীষ্য সম্পর্ক ছিলো বঙ্গন্ধুর। তিনি ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন একজন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। ১৯৫৬-২৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা দশ বছর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কাবগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন, যুগ্ম সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সাথে।
মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশেরর নাতি সৈয়দ হাদী তর্কবাগীশ একুশের সংকলনে ‘অগ্নীগর্ভে একুশ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন প্রথম তর্কবাগীশের সাথে দেখা হয় সেদিন বলেছিলেন, নেতা আমি আপনার মতো বক্তা হতে চাই।’
৩. বঙ্গবন্ধুকে কালো কোটটি উপহার দিয়েছিলো যে মাওলানা- আল্লামা শাসছুল হক ফরিদপুরী বাংলার জমিনের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন। তিনি সব সময় পাঞ্জাবির উপরে কালো কোট পরতেন। একদিন লালবাগে হুজুরের কামড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসা ছিলেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘দাদা আপনার কোটটা আমার খুব ভাল লাগে।’ সাথে সাথে সদর সাহেব হুজুর নিজের পরনে থাকা কালো কোটটি গা থেকে খুলে নাতি মুজিবকে পরিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘নাতি গায়ে দাওতো দেখি, তোমাকে কেমন লাগে।’ এরপর ফরিদপুরী বললেন, ‘দারুন তো লাগছে নেতাকে। এখন তোমাকে সত্যিকারের জাতীয় নেতা মনে হচ্ছে। ঠিক আছে এটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি সব সময় এটা পরে মিটিং মিছিলে যাবে।’ দাদা হুজরের সেই কালো কোটটি শেখ মুজিবুর রহমানের আমৃত্যু নিত্য সঙ্গী ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক ছিল কোটটি।
৪. মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক- বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদি স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ একটি বিশ্ব ব্যবস্থার। আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সোয়া দুই বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২১টি দেশের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মাঝে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং তার নেতেৃত্বে বেশ কিছু মুসলিম দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। উপস্থাপিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের তৎকালীন আমিরদের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ব্যস্ত রয়েছেন।
৫. বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয়েছিল একজন মাওলানার কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে- বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রীতি ছিল অন্তরের ভালোবাসায় সিক্ত। যে কোনো সভা-সেমিনারের শুরুতে সুযোগ থাকলে কোরআন তেলাওয়াত করানোর নির্দেশ দিতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয়েছিল। মুক্তি সংগ্রামের অনেক ঘটনার স্বাক্ষী এই জীবন্ত কিংবদন্তি মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।
৬. যে মাওলানাকে দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী ওলামা লীগ গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু- মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী ওলামা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ ও একান্ত ইচ্ছায় ১৯৬৬ সালে মাওলানা অলিউর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী ওলামা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক্ত বহু আলেম উলামা ৬ দফা কে ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা দেন়। সেই সময় মাওলানা অলিউর রহমান ‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬দফা’ নামক একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার কোন দাবিই যে ইসলামি শরিয়াহর বিরোধী নয় তা প্রমাণ করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধা শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান: জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী লিখেছেন, অলিউর রহমান ছিলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রস্তাবকারী। তিনি এ ব্যাপারে একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন, স্বতন্ত্র ধর্ম দপ্তর একটি জাতীয় প্রয়োজন। তিনি ছিলেন স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ট সহযোদ্ধা।
৭. বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রীতি বিষয়ক কিছু ছবি- বঙ্গবন্ধু একজন ইসলাম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইসলাম ধর্মসহ সকল ধর্মকে তিনি শ্রদ্ধার নজরে দেখতেন এবং একজন মুসলিম হিসেবে তিনি ইসলাম ধর্মের নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করতেন। কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু তার পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে ঈদের জামাত শেষে মোনাজত করছেন, নামাজান্তে মুসলিমদের সাথে কোলাকুলি করছেন এবং ধর্মীয় স্থাপনা দর্শনকালে মোনাজাত করছেন।
৮. এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের সম্প্রসারণ এবং ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। নিম্নে তার কিছু ইসলাম প্রিয় অবদান ও ভূমিকার তালিকা প্রদান করা হলো- ১. বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা। ২. বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন (আগে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত কোনো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ছিল না)। ৩. বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার। ৪. কাকরাইল মসজিদের জন্য অতিরিক্ত জায়গা বরাদ্দ। ৫. টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য স্থান নির্ধারণ। ৬. হজযাত্রীদের জন্য ভ্রমণ কর রহিতকরণ। ৭. বাংলাদেশ সিরাত মজলিস প্রতিষ্ঠা ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন। ৮. ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা। ৯. সুশীল সমাজ গঠনে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান। ১০. রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা। ১১. বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধকরণ। ১২. হজ্জ পালনের জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা। ১৩. ও আই সি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। এছাড়া তৎকালীন প্রায় সব বিজ্ঞ আলেম-উলামার সাথে বঙ্গবন্ধুর সুসম্পর্ক ছিল ভাল।
তথ্যসূত্র : কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, শহিদুল ইসলাম, হক কথা, ৭ নভেম্বর ২০১৫; বঙ্গবন্ধুর অন্য জীবন, সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ; আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসেন শিবলি; কে এই মাওলানা ৬ষ্ট পর্ব, তামিম রায়হান, আমারব্লগ ১১ নভেম্বর ২০১২ ইংরেজি।