নাজমুল হাসান শান্ত
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আততায়ীদের হাতে সপরিবারে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতি বছর এ দিনটি এলে কোটি প্রাণ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এবারও তার ব্যাতিক্রম নয়। দেশব্যাপী দোয়া-মিলাদসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। আর তাদের আবেগী মন বার বার জানতে চায়, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সে রাতে কী ঘটেছিল?
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা দলিল’ নামক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অভ্যর্থনা কাম ব্যক্তিগত সহকারী আ. ফ. ম. মহিতুল ইসলাম মহিত সেই রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তার সেই লেখা থেকে প্রিয়.কম-এর পাঠকদের জন্য চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হলো।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের রাত। রাত্রিতে ডিউটি ছিল আমার সহকর্মী ছাফদারের। কিন্তু রাতে ওর ব্যক্তিগত কাজ থাকায় আমাকে ডিউটি করতে অনুরোধ করল। আমার দুপুরের ডিউটি ছাফদার করল। রাত আটটায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২ নম্বরে পৌঁছালাম। ছাফদার চলে গেল। রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত গেটে পাহারারত আর্মিদের সাথে গল্প করলাম। ১টা ১০ মিনিটে আমাদের জন্য নির্ধারিত বিছানায় শুতে এলাম লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি মতিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে উঠাল। বলল, প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে টেলিফোনে ডাকছেন। সম্ভবত, তখন সময় ভোর ৪-৩০ বা ৫টা। চারদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। আমি তড়িঘড়ি করে এসে টেলিফোন ধরলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুস্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন লাগা।’
আমি টেলিফোন লাগানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করছি। সে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আমার সামনে এলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হলো পুলিশ কন্ট্রোল রুমের?’
আমি বললাম, স্যার, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ধরছে না। আমি গণভবন এক্সচেঞ্জকে ধরেছি, আমি বলছিলাম, হ্যালো আমি পি.এ.টু প্রেসিডেন্ট বলছি, অপর প্রান্ত থেকে আমার হ্যালোর প্রতিউত্তর দিচ্ছিল না, কিন্তু টেলিফোন রিসিভার সম্ভবত অপারেটরের হাতে ছিল। আমি হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক তখনি এক ঝাঁক গুলি আমাদের অফিসকক্ষের জানলার গ্লাস ভেঙে অফিসকক্ষের দেয়ালে লাগল। অন্য টেলিফোনে চিফ সিকিউরিটি অফিসার জনাব মহিউদ্দীন সাহেব টেলিফোন করল। আমি ধরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গ্লাস ভাঙা আমার ডান হাতের কনুইয়ের কাছে এসে বিঁধল। কেটে রক্ত ঝরছে। দুই জানালা দিয়েই ভীষণ গুলি আসছে। বঙ্গবন্ধু আমার টেবিলের পাশে শুয়ে পড়লেন। আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। কনুই দিয়ে বেশ রক্ত ঝরছে। বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে টান দিলেন। বললেন শুয়ে পড়তে। আমিও বঙ্গবন্ধুর পাশে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠলাম। উপর থেকে চাকর আবদুল ওনার পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এল। আমার কক্ষে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পড়লেন বঙ্গবন্ধু। বারান্দায় এসে ডাকলেন, ‘এই সেন্ট্রি, পুলিশ, সেন্ট্রি। এত গুলি চলছে, তোমরা কী করো?’ বলে উপরে উঠে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর শেখ কামাল ভাই নিচে বারান্দায় এসে বলল, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা আসুন আমার সাথে’, বলার সাথে সাথে তিন-চারজন কালো পোশাকধারী লোক সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ও ডি.এস.পি নুরুল ইসলাম সাহেব কামাল ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে। ডি.এস.পি নুরুল ইসলাম সাহেব আমাকে পিছন দিক থেকে টান দিয়ে অফিসকক্ষের মধ্যে নিয়ে গেলেন। অফিসকক্ষের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের মাঝামাঝি হাত রেখে আমি বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছিলাম, ওখানে কি হচ্ছে। গুলির শব্দে কামাল ভাই হঠাৎ আমার উপর এসে পড়লেন। উনার ধাক্কায় আমিও পড়ে গেলাম উনার পেছনে। উনি আমাকে বললেন, ‘ভাই আপনি বলুন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’
কালো পোশাকধারীদের সাথে খাকি পোশাকধারীও দেখলাম। আমর ধারণা হলো দুস্কৃতকারীরা আক্রমণ করছে। খাকি পোশাকধারীরা আমাদের সেফ করতে এসেছে, হয়ত আমাদের দুষ্কৃতিকারী ভাবছে। তাই আমি বললাম, ‘ভাই, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ শুনেই ওরা ব্রাশ ফায়ার করল। শেখ কামাল আমার উরুর উপরে বুক রেখে নিরব হয়ে গেল। উনার বুক ফুঁরে একটা গুলি লাগল আমার হাঁটুর মাঝে। কামাল ভাইয়ের রক্ত ও আমার রক্তে প্রায় রক্তস্নান হয়ে গেছি। এ সময় কোনার পুলিশ বক্স থেকে ওদের লক্ষ্য করে গুলি আসলো। ওরা ঐ দিকে পজিসন নিলো। ডি.এস.পি সাহেব কামাল ভাইয়ের লাশ ধাক্কা দিয়ে আমাকে বের করে উনার কক্ষে নিয়ে এলেন। ডি.এস.পি সাহেবের পা দিয়েও প্রচুর রক্ত ঝরছে। ওখানে দেখি এসবি’র সাব-ইন্সপেক্টর-এর রিভলবার পায়ের কাছে পড়ে আছে। উনি হতভম্ব দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। ডি.এস.পি সাহেব আমাদের পিছন গেট দিয়ে জোর করে বের করে আনলেন। গেটের বাইরে আসার সাথে সাথে একজন আর্মি আমাদের চুল ধরে টেনে দাঁড় করাল। ডি.এস.পি সাহেব অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘স্যার, আমরা সরকারি কর্মচারী। রাতে আমাদের ডিউটি ছিল, তাই এসেছি।’
আর্মি বলল, ‘ঠিক আছে আপনাদের কিছু বলব না, ওখানে লাইনে দাঁড়ান।’ দেখি, মেইন গেটের সামনে কয়েকজন পুলিশসহ টেলিফোন মিস্ত্রি লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। টেলিফোন মিস্ত্রি মতিনের পাশে ডিএসপি সাহেব এবং আমি, আমার পরে এসবি’র সাব-ইন্সপেক্টর দাঁড়াল। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবি’র সাব-ইন্সপেক্টরকে গুলি করল। গুলি বাম দিকের বুকে লাগে। বুকের রক্ত আমার ও ডি.এস.পি সাহেবের মুখে লাগে। সাব-ইন্সপেক্টর পড়ে যান। মুখ দিয়ে এক পশলা রক্ত ওঠে এলো এবং একটা কাঁপুনি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। সাব-ইন্সপেক্টরকে মেরে রাইফেল আমার দিকে তাক করল। সেই মুহূর্তে আরেকজন আর্মি এসে ধমক দিয়ে রাইফেল ছিনিয়ে নিলো। বলল, ‘তোমাকে এদের মারতে কে বলেছে?’ ঐ আর্মির আচরণ দেখে মনে হলো তিনি একজন অফিসার, যদিও তাদের কোনো ব্যাচ ছিল না। ঐ আর্মির জন্য আমার জীবন রক্ষা হলো। দেখলাম রাইফেলবিহীন ব্যক্তিকে বারান্দায় নিয়ে রাইফেলটা দিয়ে দিলো। তারপর ৪-৫ জন আর্মিকে আমাদের পাহারায় রেখে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে উপরে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস...? পরপরই গুলির শব্দ। নারীদের আর্তচিৎকার। এর ভিতর নিচের রান্নাঘর ও গোয়ালঘর থেকে রান্নার বুড়ি ও রাখাল আজিজকে আমাদের লাইনে এনে দাঁড় করাল। উপর থেকে নাসের কাকাকেও নামিয়ে আমাদের লাইনে দাঁড় করাল। নাসের কাকার হাতের আঙ্গুলগুলি সাদা কাপড় দিয়ে পেঁচানো। রক্ত ঝরছিল। তাতে মনে হচ্ছিল ওনার আঙ্গুলগুলো গুলিতে উড়ে গেছে। নাসের কাকা বললেন, ‘স্যার আমি তো রাজনীতি করি না, কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। পাশে দাঁড়ানো একজন ঘাতক বলল, ‘শেখ মুজিব বেটার দ্যান নাসের’।
যে ঘাতক গান পয়েন্টে নাসের কাকাকে নিয়ে এসেছিল সেই বলল, ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ঐ কক্ষে গিয়ে বসুন।…বলে আমাদের লাইন থেকে বের করে আবারও গান পয়েন্টে আমাদের অফিসকক্ষের সাথে অ্যাটাচড্ বাথরুমে নিয়ে গুলি করল। তারপর ঘাতক ফিরে এলো গেটের সামনে। নাসের কাকা হঠাৎ পানি বলে চিৎকার করে উঠলেন। এক ঘাতক বলল, যা পানি দিয়ে আয়, সেই ঘাতক পানির পরিবর্তে আবার গুলি করল। নাসের কাকার কন্ঠস্বর আর শোনা গেল না।
কিছুক্ষণ পর এক ঘাতক শিশু রাসেলকে নামিয়ে নিয়ে এলো। শিশু রাসেল আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ আমার ধারণা ছিল, ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে মারবে না। সেই ধারণাতেই আমি বললাম, না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।
এক ঘাতক আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে রাসেলকে নিয়ে গেটের কাছে পুলিশ বক্সে নিয়ে গেল। রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ঘাতকের কাছে কেঁদে কেঁদে আবেদন জানাচ্ছিল। ঘাতকটি রাসেলকে ওখানে একজনের পাহারায় রেখে ভিতরে গেল। অল্প কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, চলো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসি। বলে ভিতরে নিয়ে গেল। গুলির শব্দ শুনলাম। নীরব হয়ে গেল ঐ বাড়ির সমস্ত কন্ঠস্বর। সর্বশেষ হত্যাটি ছিল শিশু রাসেলের।
বাইরে থেকে তখন কর্নেল জামিল সাহেবের ডেড বডি তারই গাড়িতে করে ৩২ নম্বরে নিয়ে আসা হলো। চোখের সামনে এক আর্মি তার হাত থেকে ঘড়ি, পকেট থেকে মানিব্যাগ খুলে নিল। আমার প্রিয় হাতঘড়িটাও দেখলাম অন্য আর্মির হাতে শোভা পাচ্ছে।
আমি যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছিলাম না। ওদের অনুমতি ছাড়াই বসে পড়লাম। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। লুঙ্গিটা পায়ের সাথে লেগে গেছে। এক ঘাতক ভিতর থেকে একটা ছোট ময়লা লুঙ্গি এনে দিয়ে পরনের লুঙ্গি পাল্টাতে বলল। আমি বহু কষ্টে লুঙ্গি পাল্টিয়ে নিলাম। ঘাতক আমার গায়ের রক্তমাখা গেঞ্জিটিও খুলে নিল। আমাদের অফিসকক্ষে চেয়ারের হাতলে রাখা কামাল ভাইয়ের রক্তমাখা আমার হাফশার্টটি এনে দিলো এক ঘাতক। উপর থেকে কাজের ছেলে আবদুল ও রমাকে আমাদের লাইনে নিয়ে এলো। দেখলাম আবদুলের পেটে ও হাতে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে। লাইনে দাঁড়ানো বুড়ি আমাকে ও আবদুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘাতকদের বারবার অনুরোধ করছিল। সম্ভবত সকাল ৮টার দিকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গেল।
জানি না, বাংলাদেশ নামক এই হাসপাতালটায় আমার ব্যর্থ জীবনে এই ভয়াবহ স্মৃতি আর কতকাল বয়ে বেড়াব!