আবু আজাদ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার ঘটনায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। জাতির জনকের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান কী বলেছিলেন, তা উদঘাটনের চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে জানানো হয়, অন্যান্য দিনের মতোই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত ৮টা নাগাদ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফেরেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১২টার মধ্যেই বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে যান।
তখন বাড়ির নিচতলায় একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম। রাত তিনটা নাগাদ তিনিও ঘুমাতে যান।
এর কিছুক্ষণ পরেই সে বাড়িতে টেলিফোনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি মুহিতুল ইসলামকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কারণ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
মুহিতুল ইসলাম ২০১৬ সালে মারা যান। ১৯৯৬ সালে মুহিতুল ইসলাম শেখ মুজিব হত্যা মামলার বাদী হয়েছিলেন।
এর আগে ২০১০ সালে বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুহিতুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় আক্রমণ করছে। ওই অবস্থায় আমি পুলিশকে টেলিফোনের চেষ্টা করছিলাম। তারপরে বঙ্গবন্ধু উপর থেকে নিচে নেমে এলেন। গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা। তখন উনি আমাকে বললেন যে, আমার কাছে দে।
আমার কাছ থেকে তিনি রিসিভারটা নিলেন। নিয়ে বললেন যে, হ্যালো আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি। উনি এ কথা বলার সাথে সাথেই বৃষ্টির মতো গুলি আসা শুরু হলো। উনি গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বললেন যে, পুলিশ সেন্ট্রি, আর্মি সেন্ট্রি এত গুলি চলছে, তোমরা কী করো? আমিও উনার পিছু এসে দাঁড়ালাম। উনি এ কথা বলেই উপরে উঠে চলে গেলেন।’
এ গোলাগুলির সময় রাষ্ট্রপতিসহ তার বাড়ির কেউ ঘটনা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেননি।
‘শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালকে যখন বাড়ির নিচতলায় গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল’, বলেন মুহিতুল ইসলাম।
বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ধানমন্ডির ওই বাড়িতে সশস্ত্র হত্যাকারীরা প্রথমে হত্যা করে শেখ কামালকে। গোলাগুলির আওয়াজ শোনার পর ঘটনা সম্পর্কে জানতে বাড়ির নিচতলায় নেমে আসেন শেখ কামাল।
মুহিতুলকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাঁচ-ছয়জন আর্মি, কেউ কালো পোশাকধারী, কেউ খাকি পোশাকধারী-উনার সামনে এসে বলল, হ্যান্ডস আপ। কামাল ভাই বলছে, আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। তখনই সাথে-সাথে ব্রাশফায়ার।’
গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে মুখ তুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শেখ কামাল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যখন আক্রমণ হয়, তখন কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই হত্যাকারীরা পুরো বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।
মুহিতুল ইসলাম জানান, একজন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যে ধরনের নিরাপত্তা থাকা দরকার, সেটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিল না। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির বাড়িতে আক্রমণের পরও কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা আসেনি।
শেখ কামালকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বেপরোয়া গুলি চালিয়ে বাড়ির উপরের দিকে যাচ্ছিল। উপরে উঠেই শুরু হয় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। চারদিকে তখন শুধু গুলির শব্দ।
মুহিতুল ইসলাম বলেন, ‘উপরে তো তাণ্ডবলীলা চলছে। চারিদিকে একটা বীভৎস অবস্থা। ঠিক সে মুহূর্তে উপর থেকে চিৎকার শুরু করল যে, পাইছি পাইছি। এরপরে বঙ্গবন্ধুর একটা কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস? এরপরে ব্রাশফায়ার। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ আমরা আর শুনতে পাইনি।’
মুহিতুল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী, ধানমন্ডির সে বাড়িটিতে সর্বশেষ হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে। তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর। এ হত্যাকাণ্ডটি হয়েছিল মুহিতুল ইসলামের সামনে।
ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুহিতুল বলেন, ‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বলল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারল। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে, “আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব।” এক ঘাতক এসে ওকে বলল, “চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।” বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এত নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।’
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার পর ঘাতকরা একে অপরকে বলছিল, ‘অল আর ফিনিশড (সবাই শেষ)।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। আমিন আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যু হয় ২০১৩ সালে।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমিন আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে।
আমিন আহমেদ চৌধুরী তখনো জানতেন না যে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সেনারা আমিন আহমেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জেনারেল জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান।
জেনালের জিয়াউর রহমানের বাড়িতে ঢোকার সময় রেডিওর মাধ্যমে আমিন আহমেদ চৌধুরী জানতে পারেন যে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
সেই ঘটনা প্রসঙ্গে আমিন আহমেদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন, একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, “শাফায়াত কী হয়েছে?” শাফায়াত বললেন, “অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজ অ্যা ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি, প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।” তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেকওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’
সেনানিবাসের দুটি ব্যাটালিয়ন এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী সেটার পক্ষে ছিল না বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়েছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনার খবর কেন আগে জানা সম্ভব হয়নি এবং কেন সেনাবাহিনীর অন্য কোনো ইউনিট এগিয়ে যায়নি, সেটি আজও এক বিরাট প্রশ্ন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আক্রমণের সময় শেখ মুজিবুর রহমান তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোন করে তার বাড়িতে আক্রমণের কথা জানিয়েছিলেন। কর্নেল জামিল সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে।
কিন্তু সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে জামিল গাড়ি রোধ করে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সেনারা। সেই বাধা উপেক্ষা করে কর্নেল জামিল সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সকাল ১০টার দিকে আমিন আহমেদ চৌধুরী গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে।
ভোর সাড়ে চারটা নাগাদ হত্যাকাণ্ড হলেও তখন সেখানে মৃতদেহ দেখেছেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। সামরিক পোশাক পরা অবস্থায় আমিন আহমেদ চৌধুরী সেখানে গেলেও তাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না সেনারা।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘আর্টিলারি রেজিমেন্টের কিছু ট্রুপস ছিল সেখানে। মেজর হুদা ছিলেন। আমি যেহেতু হুদাকে চিনতাম, তাকে বলার পর সে আমাকে ঢুকতে দেয়। আমি দোতলার সিঁড়িতে উঠতেই বঙ্গবন্ধুর লাশটা দেখি। তার চশমা ও পাইপটাও পড়ে ছিল। দূর থেকে ভেতরে দেখলাম বেগম মুজিব পড়ে আছেন। যে লোকটার অঙ্গুলি হেলনে পঁচাত্তর মিলিয়ন লোক উঠছে বসছে, সে লোকটাকে তার সৃষ্ট আর্মি মেরে ফেলল। এটা কী করে সম্ভব? পাকিস্তানিদের কাছে মারা যায় নাই, মারা গেল শেষ পর্যন্ত বাঙালির কাছে।’
সে অভ্যুত্থানের পর অনেকে তাকিয়ে ছিলেন তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার দিকে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর কোনো সংঘাত তৈরি হয় কি না, সেটি নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরনের কিছু ঘটেনি। রক্ষীবাহিনীর দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর উল্টো রক্ষীবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বলে জানান আমিন আহমেদ চৌধুরী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে আমিন আহমেদ চৌধুরী দুপুর নাগাদ পৌঁছান সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়িত্ব ছিল রক্ষীবাহিনী যাতে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়, সে বার্তা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এ বিষয়ে এই সেনা কর্মকর্তা বিবিসিকেবলেছিলেন, ‘আমি সেখানে গিয়ে বলি যে, সেনাবাহিনীর কিছু লোক এটার (হত্যাকাণ্ড) সাথে জড়িত থাকলেও পুরো সেনাবাহিনী এর সাথে জড়িত নয়। সে হিসেবে সেনাপ্রধানের বাণী নিয়ে আমি এখানে আসছি।’
হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। সামগ্রিকভাবে ১৫ আগস্ট সারা দিন সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
অভ্যুত্থানের খবর জানাজানি হওয়ার পর সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেই এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। কী করতে হবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
আমিন আহমেদ চৌধুরীর ভাষ্য, ‘যখন সকাল হয়ে গেছে, তখন দেখা যাচ্ছে, কোনো পলিটিক্যাল ডিরেকশন আসতেছে না। বঙ্গবন্ধু মারা গেছে, এখন আমরা কী করব? কার পেছনে দাঁড়াব? তারা তো খন্দকার মোশতাককে বসিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা তাকে ডিজলস (ক্ষমতাচ্যুত) করব? এর বিরুদ্ধে গেলে পুরোপুরি যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ওরা ট্যাংক বের করে অলরেডি বঙ্গভবনে বসে গেছে, ফার্মগেটের সামনে বসে গেছে, জাহাঙ্গীর গেটের ভেতরে অলরেডি মুভ করছে।
পরিস্থিতি অ্যাসেস করতে হচ্ছে। আমরা কী পারব? আমাকে তো জানতে হবে আমার কাছে কত সৈন্য আছে এবং কত অ্যামুনিশন আছে। এতে গিয়া গোলমাল হয়ে গেল। কনফিউশনটা খুব বেশি ছিল।’