নঈম নিজাম:
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, আমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ইন্দিরা গান্ধী। তারপর তিনবার দেখা হয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। দেশ চালিত হতে শুরু করে এই ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। তাজউদ্দীন আহমদসহ বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধারা সেভাবে দেশকে পরিচালিত করেন। মানুষও তাদের নেতার নির্দেশনা মেনে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে গত ৭ মার্চ দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার একটি অংশ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছে। আজ ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার, তাজউদ্দীন আহমদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপচারিতার বাকি অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
- দাদা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই ছিল?
- না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরিচয় হয়। আগে থেকে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ হয়নি। তবে প্রথম পরিচয়েই আপন হয়ে উঠি। সেই কথা পরে বলছি।
- হ্যাঁ, আমরা ৭ মার্চ নিয়ে কথা বলছিলাম...।
- ৭ মার্চের এই ভাষণের মধ্যেই সবকিছু ছিল। একটি দেশ কীভাবে যাত্রা করবে, সেই নির্দেশনা ছিল সর্বস্তরের মানুষের জন্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা এই নির্দেশনার ভিত্তিতে এগিয়ে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে।
- পুরো ঘটনাবলি আপনার বইতে আছে তো?
- দেখুন, হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ হিসেবে দেখলে ভুল করবেন। কারণ এটা হলো আমার ইমপ্রেশান। তখন অনেক ঘটনাবলি ছিল। ঘটনাগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে আমার নিজের যা মনে হয়েছে আমার যা রিঅ্যাকশন তা লিখেছি। আমি তখন অনেক সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম ভারতীয় তরুণদের কীভাবে এনকারেজ করা যায়। বাংলাদেশ থেকে এত মানুষ আশ্রয় নিল তাদের রাখার বিষয়টি অনেক বড় ছিল। সেসব নিয়ে আমরা কাজ করেছি। সে সময় ভারতীয় পার্লামেন্টে, মিডিয়ায় আমরা কথা বলেছি। সবচেয়ে বড় একটা বিষয় ছিল ইন্দিরা গান্ধীর অবস্থান। কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ভারত প্রস্তুত না থাকলে ৩ নভেম্বর এত দ্রুত রেসপন্স করতে পারত না। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, দেখো, এটা কোয়াইট ন্যাচারাল। যখন ঝামেলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যে অতীত ইতিহাস আছে তাতে জীবনেও দেখনি তারা গুলি ছুড়েছে আর ভারত কোনো রিঅ্যাকশন দেখায়নি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব প্রস্তুত থাকা। ইন্দিরা গান্ধী কীভাবে স্টেপ বাই স্টেপ নিজেকে বিল্ডআপ করেছিলেন, আমি সেটাই দেখাতে চেয়েছি বইতে। আমার এই ভলিউমের নাম ‘ভলিউম অন ইন্দিরা’। এখানে সময়টা ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৮ সাল। রাজনীতিতে আমার আদর্শ ইন্দিরা গান্ধী।
- বইতে ইতিহাসের খ খ অংশ আছে বলা যায়।
- মুজিবনগরে সরকার তৈরি হওয়ার পর আমি আরেকটা প্রেশার বিল্ডআপ করার জন্য পাবলিক ওপিনিয়ন হিসেবে পার্লামেন্টে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে প্রস্তাব এনেছিলাম। বাংলাদেশ আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যাডপ্ট করেছিল ‘মুজিবনগর সরকার’। আন্তর্জাতিক কারণগুলোর অবস্থান, বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে যত তথ্য পেয়েছিলাম সব তুলে ধরি। আমাদের পার্লামেন্টে একটা নিয়ম আছে, তোমার বক্তৃতা যদি শেষ না হয় তাহলে রেজুলেশনটা ওখানেই স্টপ হয়। ওটার ওপর কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। আমার ভয় ছিল এ কারণে, যদি কোনো কারণে যুদ্ধ থেমে যায় যে ছেলেগুলো যুদ্ধ করছে, তাদের পরিণতি কী হবে? আওয়ামী লীগের ওপর একটা প্রতিক্রিয়া হবে। তখনো নেগোসিয়েশনের চেষ্টা চলছিল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দরবারে। তাই রাজ্যসভার প্রস্তাব পেশ করে সুপারিশ করেছিলাম, মুজিবনগরে নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকার যেন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং স্বীকৃতি দেয়। তখন জনৈক সাংসদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কীভাবে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যাবে? তখন বলেছিলাম এই সমাধান মানে রাজনৈতিক সমাধান। শুরু থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর অবস্থান ছিল স্পষ্ট। একটা কথা বলে রাখি, সার্বিক অবস্থার অবনতি বন্ধ হয়ে যায় ইয়াহিয়া পালিয়ে যাওয়ার পর। ৭ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনা করলেন মুজিবের সঙ্গে। আলোচনার নামে সময় নষ্ট করে তারা দুজন পালিয়ে গেলেন। দেশ তো চলছিল মুজিবের নির্দেশনা অনুসারে। ইয়াহিয়ার স্ট্র্যাটেজি ছিল, আলোচনার সময় বিমানে করে যত বেশি সম্ভব সৈন্য নিয়ে আসা। ইয়াহিয়া আলোচনার পুরো সময়টা ব্যবহার করলেন সৈন্য আনার কাজে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস, আমরা উৎকণ্ঠায় ছিলাম মুজিবকে নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগারে তিনি বন্দী ছিলেন। বিভিন্ন বই পড়ে পরে সব তথ্য পেয়েছি। কারাগারে বঙ্গবন্ধু ভীষণ খারাপভাবে ছিলেন। একটা মানুষকে যত ধরনের যন্ত্রণা-কষ্টের মাঝে রাখা যায় তাঁকে সেভাবেই রাখা হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পর আরেক ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রেশার পড়ে মুজিবের ওপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁকে নেওয়া হয় পাঁচতারা হোটেলের মর্যাদার বাংলোতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এসব খবর সঠিকভাবে দেওয়া হতো না। সার্বিক সর্বশেষ সব খবর লন্ডন গিয়ে তিনি জানতে পারেন বাঙালিদের কাছ থেকে। পাকিস্তান ছাড়ার আগে একবার অ্যাক্সিডেন্টাললি ভুট্টো তাঁকে বলেছিলেন, তোমাকে মুুক্তি দেওয়া হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তুমি তার প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তানে শেষ মুহূর্তেও নানা ধরনের চাপ দেওয়া হয়। একটা জয়েন্ট স্টেটমেন্ট সই করানোর চেষ্টা হয়- ‘বাংলাদেশ পার্ট অব পাকিস্তান’। একসঙ্গে নতুন প্রক্রিয়ায় থাকা যায় কিনা সেসব চেষ্টাও চলে। কিন্তু মুজিব তাঁর অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। মিয়ানওয়ালি নামে একটি জায়গায় নয় মাস ধরে একটি জেলে তাঁকে বন্দী রাখা হয়। প্রচ গরম, প্রচ ঠা া। যখন ২ ডিগ্রি, ১ ডিগ্রি ওখানকার তাপমাত্রা তখন তাঁর জন্য ছিল একটা মাত্র পাতলা কম্বল। একটা কম্বল পেতেন বিছানোর জন্য, আরেকটা গায়ে দেওয়ার জন্য। সারারাত ঘুম হতো না। ওই কম্বলটি গায়ে জড়িয়ে তিনি বসে থাকতেন। ১৬ ডিসেম্বরের পর তাঁকে এক জেনারেলের আরামদায়ক বাংলোয় নেওয়া হয়। ছয় দিন রেখে ২৬ ডিসেম্বর নেওয়া হয় আরেক বাংলোয়। সেখানে চার দিন রেখে নেওয়া হয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেইনটেন করা আরেক বাংলোয়। এগুলোও ছিল এক ধরনের চাপ। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী হচ্ছে। তাঁর চারপাশের সব লোকই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার। একদিন কফি খেতে চাইলেন। তারা কফি ও স্যান্ডইউচ দিলেন খেতে। তিনি বুঝলেন সাধারণ কোনো কর্মচারীর বানানো কফি আর স্যান্ডইউচ নয়। সেনা মেসে এমন বানানো হয়। এ সময় বাংলাদেশের সব খবর তারা ঠিকভাবে দেননি। একবার তাঁকে বললেন, তোমার পরিবারের সবাই বেঁচে আছে। আটককালে জেলখানায় তিনি গার্ডদের কাছে জানতে চাইতেন বাংলাদেশের সর্বশেষ খবর। তারা সব বলতেন না। যুদ্ধ হচ্ছে এই কথা বলেছেন। কিন্তু কী অবস্থা তা পরিষ্কার করতেন না। তারপর তো লন্ডন গেলেন। দেশে ফিরলেন। সে আরেক ইতিহাস। আমি পাকিস্তানের কারাগারের বিষয়গুলো বিভিন্ন বইতে পড়েছি। প্রচ মানসিক শক্তি ছিল। বিশাল মানসিক শক্তি ছিল বলেই লড়তে পেরেছিলেন। জেলখানায় তাদের কোনো প্রস্তাবই পাত্তা দেননি। মৃত্যুভয় তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। সেজন্যই স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।
- বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতার আগে-পরে আপনার অনেক ভূমিকা ছিল।
- স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির জন্য তখন অনেক দেশ সফর করেছি।
- আপনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিচয়ের কোনো কিছু মনে আছে কি?
- আছে। ইন্দিরা গান্ধী আমার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আলাপ হয় প্রাণবন্ত। তিনি বললেন, মুখার্জির বাড়ি কোথায়? আমি হাসতে হাসতে বললাম, ঘটি স্যার ঘটি। পরে নিজের বাড়ি শান্তিনিকেতনে বলতেই উনি পরিষ্কার ভরাট কণ্ঠে আমাকে রবীন্দ্রনাথের দুটি কবিতা শুনিয়ে দিলেন। আমি মুগ্ধ হলাম তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ শুনে। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন।
- বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে র খবর কীভাবে শুনলেন?
- এটা অফিশিয়ালভাবে শুনেছি। ভোরে আমাকে খবর দেওয়া হলো। আমি কলকাতায় ছিলাম। হত্যাকান্ডে র খবর শুনে হতচকিত এবং শোকাহত হই। মনে হলো যেন স্বজন হারিয়েছি। এটা কেবল প্রতিবেশী এক রাষ্ট্রের সংকট নয়, ব্যক্তিগত শোকের বিষয় ছিল সেই দিন।