জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় নানা কারণে ও বিভিন্ন সময়ে পাবনা জেলায় ছুটে এসেছিলেন। কখনো সাংগঠনিক সফরে, কখনো নির্বাচনী সফরে। কখনো এসেছেন রাষ্ট্রীয় সফরে। কখনো এসেছেন আনন্দ নিয়ে। একাধিকবার এসেছেন ব্যথা আর বেদনা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু পাবনাকে ভালবাসতেন, ভালবাসতেন পাবনার মানুষকে। তার একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসের এর শশুর বাড়ী পাবনায়। ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল একবার পাবনায় আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার সাহাবউদ্দিন চুপপু বলেন, তখন তিনি এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। পাবনা টাউন হল ময়দানে জনসভা হবে বিকাল ৩টায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুপুরে খাবারের আয়োজন ছিল তৎকালীন পাবনা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব বগা মিয়ার বাসায়। আবদুর রব বগা মিয়া আমার প্রতিবেশী ছিল এবং আমি তার পরিবারের একজন সদস্যের মতোই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখার বিশেষ সুযোগ হলো। বগা চাচা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মী নেতাদের সঙ্গে। পরিচয়পর্ব শেষে একটু বিশ্রামের সময় পাবনা জেলা ছাত্রলীগ নেতা আকবর মজিদ, শফিকুল আজিজ মুকুল, রবিউল ইসলাম রবি, আবদুস ছাত্তার লালু, সোহরাব উদ্দিন সোবা, আবুল আহসান গোরা প্রমুখকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বললেন ওকে অর্থাৎ আমাকেও যেন সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তো এক দেখাতেই মুগ্ধ এবং তার নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দ ও উত্তেজনায় সভাস্থলে উপস্থিত হই। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতায় আমি মুগ্ধ শ্রোতা থেকে মনের অজান্তে জানি না কখন যে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে গেলাম। গগনবিদারী শ্লোগানে মুখরিত টাউন হল ময়দানে ঘুরে ঘুরে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে শ্লোগান দিতে থাকলাম। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা...। পরবর্তীতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও পরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়েছিল।
শাহবুদ্দিন চুপপু আরো বলেন, স্বাধীনতার পর কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎসমূহের মধ্যে একটি ঘটনা আমাকে সব সময় আলোড়িত করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে মুজিববাঁধ উদ্বোধন করতে পাবনায় আসেন। আমি তখন ছাত্রলীগের সভাপতি। প্রথমদিকে শ্রেণি-বিন্যাসে আমার বক্তৃতার সুযোগ ছিল। আমার বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন ‘তুই তো ভালো বলিস’। অনুষ্ঠান শেষে হেলিকপ্টারে উঠার আগে তিনি তার সহযাত্রীদের সঙ্গে আমাকে ও তখনকার পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে তার হেলিকপ্টার উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর উদার মানসিকতার কারণে সে দিন আমার প্রথম হেলিকপ্টারে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন এরকম আরো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম রবি। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতিকে ৬ দফার আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জেলায় তিনি জনসভা, পথসভা ও কর্মীসভার মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন। ৬ দফার আন্দোলনে শরিক হওয়ার প্রচার অভিযানের অংশ হিসাবে তিনি পাবনায় আসেন এবং পাবনা টাউনহল মাঠে জনসভায় বক্তব্য দেন। সেদিনের বঙ্গবন্ধুর জনসভা সফল করার জন্য আমরা একাধিকবার মিটিং করি। আমরা একেকজন একেক দায়িত্ব ভাগ করে নেই। সবার অংশগ্রহণে সেদিনের জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এছাড়াও নকশালদের হাতে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এম,সি,এ) আহমেদ রফিক খুন হবার পর ও আবদুর রব বগা মিয়া মারা যাবার খবরে পাবনায় ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম রবি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তারা চলাফেরা ছিল খুবই স্বাভাবিক।
বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন ও তার সহচার্য লাভ করেছিলেন আরেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক আমিরুল ইসলাম রাঙা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালে পাবনা টাউন হলে। তখন আমি ১৩/১৪ বছরের কিশোর। সেদিনের সেই মনোমুগ্ধকর ভাষণই আমাকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। ১৯৭০ সালে দেখেছিলাম দুইবার। একবার রাজনৈতিক সফরে পাবনা এলে বগা চাচার বাড়ীতে উনার সাক্ষাৎ পেয়ে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ এর বিরুদ্ধে আমার লেখা কবিতা শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। পরেরবার এলেন ‘৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। পাবনায় নকশালপন্থীদের হাতে নিহত নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আহমেদ রফিক খুন হবার পর। স্বাধীনতার পর কাছে থেকে দেখেছিলাম ১৯৭২ সালে ২০শে জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে।
আমিরুল ইসলাম রাঙা বলেন, তারপর দেখা ১৯৭২ সালের ১০ মে। স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুইদিনের জন্য পাবনা সফরে এলেন। যথারীতি নির্ধারিত সময়ে হেলিকপ্টার নিয়ে পাবনা স্টেডিয়ামে (জিন্নাহ পার্ক) অবতরণ করলেন। সফরসঙ্গী তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। স্টেডিয়ামে হাজার হাজার জনতা। পুলিশ, মিলিটারী আর পাহারাদার চোখে পড়ছে না। হেলিকপ্টার অবতরণের পর বঙ্গবন্ধু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সকল মানুষকে হাত নেড়ে সালাম জানাচ্ছেন আর স্বভাবসুলভ সেই হাত নিজের মাথায় বুলিয়ে নিচ্ছেন। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। স্টেডিয়ামে হাজার হাজার জনতা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু সবার সাথে হাত মিলাচ্ছেন। কথা বলছেন আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার জন্য নিজের হাতে বানানো মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে আছেন পাবনা পলিটেকনিকের তৎকালীন জিএস আবদুল হাই তপন, আবুল কাশেম বিশ্বাস (বর্তমানে পাবনা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার), আল মাহমুদ নিটু (বর্তমানে পাবনা জেলা জাসদের সহ-সভাপতি) প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে এলে উনাকে মাল্যদান করে বললাম আমি রাঙা। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইছামতি পত্রিকার সম্পাদক। পাবনা জেলা স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক। আমি আপনাকে পাকিস্তান দেশ কৃষ্টির বিরুদ্ধে লেখা কবিতা শুনিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমার কথা শেষ না হতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আশীর্বাদ ও ভালবাসায় সিক্ত করলেন। সন্ধ্যার পর বনমালীতে নাগরিক সংবর্ধনায় স্বহস্তে লিখিত মানপত্র দেবার সুযোগ পেয়েছিলাম।
সেদিনের বক্তব্যের শেষে পাবনাবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালবাসা, দিয়ে গেলাম তাই।’