সেলিনা খালেক
“শেষ দেখা দেখেছিলাম হাস্যোজ্জ্বল নেতাকে শেখ কামালের বিয়েতে। খালেক সাহেব টাই-স্যুট পরে গিয়েছিলেন। উনি টাই ধরে বললেন, ইস, একবারে টাই-স্যুট পরে এসেছে। খালেক সাহেব জবাব দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে টাই-স্যুট না পরলে কেমন দেখাবে?”
শেখ মুজিবুর রহমানকে কবে প্রথম দেখেছি সঠিক দিন-তারিখ বলতে পারবো না। কিন্তু প্রথম দেখাতেই যে খুব ভালো লেগেছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে আপন করে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার।
গোপালগঞ্জের তৎকালীন এসডিপিও জনাব আবদুল খালেকের সাথে। আমার বিয়ে হয় ১৯৫৩ সালের ২ অক্টোবরে, ঢাকায়। আমি তখন ঢাকায় ইডেন কলেজে আইএ ২য় বর্ষে পড়ি। আমার আব্বা জনাব এ. কে. এম. হাফিজউদ্দিন সে সময়ে রাজশাহী রেঞ্জের ডি.আই.জি. পুলিশ। বিয়ের কয়েক দিন পরই খালেক সাহেব কাজে যোগদান করেন। আমি সাথে যাইনি। একবারে আইএ পরীক্ষা দিয়ে ১৯৫৪ সালে গোপালগঞ্জে যাই।
তখন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। গোপালগঞ্জে একদিকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যদিকে ওহিদুজ্জামান সাহেব। দুজনই আমার আব্বার আত্মীয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মামা এবং চাচা জনাব শেখ মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আব্বার আপন চাচাতো বোন। সেই সূত্রে আব্বাকে শেখ সাহেব মামা সম্বোধন করতেন। আর ওহিদুজ্জামান সাহেবের ছোটো ভাই ফয়কুজ্জামানের স্ত্রী ছিলেন আব্বার খালাতো ভাইয়ের মেয়ে। খালেক সাহেব দুই পক্ষেরই জামাই ছিলেন। নির্বাচনে দুই পক্ষ দুই দলে। কিন্তু খালেক সাহেব নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠা দিয়ে নির্বাচনের সময় কাজ করেছেন। কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। তারাও কখনও তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেনি। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই খালেক সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল।
একদিন হঠাৎ দুপুরের দিকে এলেন। সেদিন ছিল শবেবরাত। সে সময় একটা প্রথা চালু ছিল যে শবেবরাতে ভালো খাওয়া দাওয়া করলে, নতুন কাপড় পরলে, দান খয়রাত করলে সারাটা বছর ভালো থাকা যাবে। সে সময় আমরা আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কবরস্থান জিয়ারত এবং মসজিদ ও গরিব দুঃখীদের মধ্যে হালুয়া-রুটি বিতরণ করাকে সোয়াবের কাজ বলে মনে করতাম। দুপুরে পোলাও রান্না করা হয়েছিল। তাকে খেয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। তিনি উল্টো আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তুই কি রান্না করতে জানিস?” আপনারা অনেকে হয়তো জানেন, তিনি তার চেয়ে বয়সে ছোটো এবং যাদেরকে স্নেহ করতেন, তাদেরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি আমাদের দুজনকেই তুই বলতেন। আমার এখনও মনে আছে, তিনি আমার বাসায় সেদিন খুব তৃপ্তিসহকারে খেয়েছিলেন। তাকে আর কখনও খাওয়ানোর সুযোগ আমার হয়নি।
স্বাধীনতার পর একটি অনুষ্ঠানে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। আমরা সবাই জানি, অসাধারণ ছিল তার স্মৃতিশক্তি। কবে কোথায় কার বাড়িতে কী দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন তা তিনি মনে করে বলতে পারতেন। তাদের গ্রামের বাড়িতে কবে অনেক রকম মাছ দিয়ে আমার বড় ভাসুর খাইয়েছিলেন তা তার মনে আছে। কে কার আত্মীয় সেটাও তিনি মনে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, খালেক সাহেব অফিসের কাজে আপনার বাসায় গেলে ভাবি সব সময় খাইয়ে দেন। আমার সে সৌভাগ্য হয়নি। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, “তুই গেলে তোর ভাবি তোকেও খাওয়াবে”।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সারদা পুলিশ একাডেমিতে গিয়েছিলেন। খালেক সাহেব তখন আই জি পুলিশ। সেখানে স্মৃতিস্তম্ভে তিনি পুস্পস্তবক অর্পণ করে ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন, আমি জানি, তোরা অনেক কষ্ট করেছিস ’৭১-এ । আমি বলেছিলাম, আল্লাহর অসীম কৃপায় আমরা বেঁচে আছি, যদিও আমাদের সবকিছু লুটপাট হয়ে গেছে। আজ হয়তো এই স্মৃতিস্তম্ভে আপনি আমাদের জন্যও দু’ফোটা অশ্রু ফেলতেন। জবাবে বললেন, তুই অনেক বেশি কথা বলিস। ১৯৭৫ পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানে তাকে দেখলাম। সব সময় কথা বলার সুযোগ হতো না।
শেষ দেখা দেখেছিলাম হাস্যোজ্জ্বল নেতাকে শেখ কামালের বিয়েতে। খালেক সাহেব টাই-স্যুট পরে গিয়েছিলেন। উনি টাইটা ধরে বললেন, ইস, একবারে টাই-স্যুট পরে এসেছে। খালেক সাহেব জবাব দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে টাই-স্যুট না পরলে কেমন দেখাবে?
১৯৭৫-এ নানা পত্রপত্রিকায় নানাজনের নানা ভবিষ্যদ্বাণী ও নানারকম গুজব বের হলে, খালেক সাহেবের হাতে আসতো, তা তিনি বন্ধবন্ধুকে দেখাতেন। তিনি হেসে বলেছিলেন, আমি এসব বিশ্বাস করি না। কথাগুলো ১৫ আগস্ট সত্যি প্রমাণিত হলো। প্রিয় নেতার পোশাক রক্তাক্ত হলো।
আমরা তখন সিদ্ধেশ্বরীতে থাকি। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে খালেক সাহেব রমনা থানায় ফোন করলেন। ধানমণ্ডি শব্দ বোধ হয় আমরা শুনিনি। রমনায় সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় গোলাগুলির শব্দ। পরে রেডিওতে মেজর ডালিমের দম্ভভরা গলায় মর্মান্তিক খবরটা শুনলাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। আমরা সবাই ভীষণভাবে মর্মাহত। খালেক সাহেব বেশ কয়েক দিন অফিসে যাননি। আমরা দুজনেই তাকে ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করতাম ও ভালোবাসতাম। গানের সাথে গলা মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে- “যদি রাত পোহালে শোনা যেত বন্ধবন্ধু মরে নাই”।