হাসানুর রশীদ
বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি লন্ডন যান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উড্রো উইলসনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘরোয়া বৈঠক করেন। তারপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
মুজিবনগর সরকারের নির্দেশবলে সে সময়ও তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেন। পরে পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেদিন বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিবর্তনীয়, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বতন সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা নয়।’
বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত মুমূর্ষু এক জনপদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসব্যাপী পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এ দেশের ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। জ্বালাও-পোড়াও নীতির ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিকসহ সব অবকাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময় দেশের স্কুল-কলেজ, শিল্প ও কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ তো বটেই, এসব ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয় কৃষিক্ষেত্র। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী আধাসামরিক বাহিনী দেশের ৪৩ লাখ বসতবাড়ি, প্রায় ২৫ হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ভবন, তিন হাজার অফিস ভবন ও ১৯ হাজার হাটবাজার পুড়িয়ে দেয়। ২৭৪টি সড়ক সেতু, ৩০০টি রেল সেতু সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৭২ কিলোমিটার রেললাইন সম্পূর্ণ এবং ২০০ কিলোমিটার রেললাইন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি সেনারা জেলা পর্যায়ের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেয়। আবার পাকিস্তানি বাহিনী খাদ্যগুদামে আগুন দিয়ে সংরক্ষিত খাদ্যশস্য নষ্ট করে দেয়। কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। ব্যাংকগুলোয় কাগজের নোট পুড়িয়ে দেয়। ব্যাংকে রক্ষিত রৌপ্য-স্বর্ণ লুট করে। ফলে যুদ্ধ-পরবর্তী মুজিব সরকার শূন্য অর্থনীতির একটি বিপর্যস্ত দেশ লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি-বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কারিগরি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ও নির্বাহের ক্ষেত্রে অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আধিক্য ছিল। অধিকাংশ বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। যুদ্ধের শেষ দিকে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু সরকার সেসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেন। এভাবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ইশতেহার অনুয়ায়ী ব্যাংক, বিমাসহ ৪০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়।
সরকার বড় পরিসরের পরিকল্পনা কমিশন, জাতীয় অর্থনীতি কমিশন গঠন করে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট সরকারের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাতে রাষ্ট্রের উন্নয়নও ব্যাহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার, তাদের পুনর্বাসন, ইন্ডিয়ার সোয়া লাখ সৈন্য ফেরত পাঠানো, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের আটক ও বিচারের ব্যবস্থা করা, পাকিস্তানে আটক ৪ লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনা, কয়েক লাখ অবাঙালিকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো, নতুন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের স্বীকৃতি লাভের ব্যবস্থা করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ প্রভৃতি কাজে বঙ্গবন্ধু সরকারকে নজর দিতে হয়েছে।
প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধু সরকার গঠনের পর একটি কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করতে সফল হয়েছিলেন। বেসরকারি পর্যায় থেকে দেশ গঠনে একটি অঙ্গীকার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধপরবর্তী দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পুনর্গঠনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের মধ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেছেন। ১৯৭৪ শালের ৭ জুন এ কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে।
বঙ্গবন্ধু কৃষি ব্যবস্থাপনায় সর্বাধিক মনোযোগ দেন। কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব উপকরণ সরবরাহ করেন। বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভে সরকার সফল হয়। সাধারণ জনগণের মাঝে বছরব্যাপী ত্রাণসামগ্রী হিসেবে চাল, ডাল, গম ও কম্বল বিতরণ করা হয়। ১৯৭২ সালের মধ্যেই কৃষিক্ষেত্র ফিরে পায় স্বাভাবিকতা।
ক্ষমতা গ্রহণের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে কোনো সংবিধান ছিল না। স্বল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান ও অন্যান্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হয়। একটি অসাধারণ সংবিধানসহ প্রয়োজনের নিরিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার এক বছরের মধ্যে প্রায় দেড়শ আইন প্রণয়ন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মৌলিক আইনের ভিত্তিতে দেশ শাসন করেছেন। ১৯৭২ সালে ১১ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সেসব আইনকে ‘অস্থায়ী সংবিধান’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ‘অস্থায়ী সংবিধান’ আদেশবলে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘গণপরিষদ’ ও ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য’ নামে দুটি আদেশ জারি করা হয়।
‘গণপরিষদ আদেশ’ এর মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। একটি সংবিধান প্রণয়ন করা এই পরিষদের দায়িত্ব ছিল। দ্বিতীয়টিতে নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্ত দল থেকে পদত্যাগ বা বহিষ্কৃত হলে সদস্যপদ বাতিলবিষয়ক আদেশ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য কলকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থপনার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে বলে ১৯৭২ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দালাল আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (কোলাবোরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার-১৯৭২) গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য দুষ্কর্মে সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যসহ অন্যদের বিচারের জন্য এ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১২ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট পাকিস্তানি আমলের গণবিরোধী ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডার’ বাতিল এবং নতুন প্রিন্টিং অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তিনি মদ তৈরি ও বিপণন, সব ধরনের জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে ১৪টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের সবসময় সম্মানের মণিকোঠায় রেখেছেন।
তিনি তাদের গৌরবকে চিস্মরণীয় করার জন্য ১৯৭৩ সালের ২৫ মার্চ ৫৪৬ ব্যক্তিকে মুক্তিযুদ্ধে শৌর্য ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বীরত্বসূচক বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। তার মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম, ১৫৯ বীরবিক্রম ও ৩১২ জন বীরপ্রতীক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৫ মে বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকের কাছে খাসজমি বণ্টনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিওকুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়।
‘কারও শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’- এই দর্শনে পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। তবে স্বাধীনতার পর সরকারের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় সাফল্য ছিল যুদ্ধের পর বাংলাদেশকে দ্রুত ইন্ডিয়ার সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত করা। বঙ্গবন্ধু সরকারের অসামান্য দক্ষতায় ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্ডিয়ার বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ মার্চ ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং বাংলাদেশের প্রতি ইন্ডিয়ান সরকারের ২৫০ মিলিয়ন ডলারের পুনর্বাসন সাহায্য লাভ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৩ সালের ১৬ থেকে ১৮ জুলাই গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পানিবণ্টন প্রশ্নে ভারত-বাংলাদেশ একমত না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তিনি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর হন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতার কারণে যুক্তরাজ্য ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চ এবং পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে বিশ্বের ১২১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর উদার পররাষ্ট্রনীতির কারণে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া ও মৌরিতানিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৯৭৪ সালের ১২ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরি, জার্মানি, মঙ্গোলিয়া ও ভারতের অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনই আজকের একুশের বইমেলার সূচনা করেছে।
-হাসানুর রশীদ
লেখক ও গবেষক