১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ। এদিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একদিন বিরতির পর তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠকের স্থায়িত্ব ছিল ৯০ মিনিট। আলোচনা চলে ওয়ান টু ওয়ান অর্থাৎ বৈঠকে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না।
a
বৈঠক শেষে দুপুর ১২টায় নিজের ধানমন্ডির বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি দেশের সবশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেছি। আলোচনা সমাপ্ত হয়নি, এটা অব্যাহত থাকবে। কাল সকাল ১০টায় আবারও প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনা হবে। এর আগে আজ সন্ধ্যায় আমার প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনায় সামান্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরও সময়ের প্রয়োজন।
আমি বিশ্বাস করি, জেনারেল ইয়াহিয়া বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে দীর্ঘ দু’ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্টের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে প্রেস ব্রিফিংয়ে তাজউদ্দীন আহমদ জানান, উপদেষ্টা পর্যায়ের এ বৈঠকেও দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সমস্যাবলির বহু বিষয় আলোচিত হয়েছে।
বৈঠকে কোনো বিশেষ ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এ বিষয়ে আজ কিছু বলব না। আজ এটুকুই বলছি, বহু কিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শাসনতান্ত্রিক ইস্যুতে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই! শাসনতান্ত্রিক সংকটই তো আজ দেশের মূল সমস্যা।
এদিকে, ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে পাকিস্তানি সেনারা বেশ কয়েকজন নিরস্ত্র বাঙালি সৈনিককে গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়োগকে ভয় পায়।
জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয় তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নাই। জয়দেবপুরের ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানি শাসকরা জয়দেবপুরে দীর্ঘ ২৯ ঘণ্টার কারফিউ জারি করে রাখে। তবে কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পরপরই জয়দেবপুরের বিক্ষুব্ধ জনতা আবার পথে নেমে আসে।
এদিন ঢাকার সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পেট্রোভ ভলটিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার ও জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বর্তমান সংকটের একটি ন্যায়সংগত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করি।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জানা উচিত, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকারও তার নেই।
এদিকে, পাকিস্তানে বসে এক বক্তৃতায় হুঙ্কার ছাড়েন ভুট্টো। তিনি বলেন, আমি এখন পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের আমাদের আর কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের হিস্যা হতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমিও চুপ করে থাকব না।
আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন এবার পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখবেন! ভুট্টোর এই উসকানিমূলক বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।