বাংলাদেশের উদ্ভবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

এ কথা আমাদের সবার জানা যে, ইংরেজদের পশ্চাদপসারণের কারণে অখ- ভারত থেকে দ্বিখ-িত পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হয়েছিল। তবে এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন না, সেদিনের তরুণ শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তবে পার্থক্য এই, সেদিন তিনি ছিলেন দশের মধ্যে এক, আর সময় তাকে এখন দশের মাঝে একাদশের স্থানটিতে বসিয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনে অনেক শরিকের মতো শেখ মুজিবও একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী মানবিক সমাজের কথা চিন্তা করতেন। ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ছিলেন উদার এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে ও শিক্ষার বিশেষ পারিপার্শ্বিকতা তাকে মানবপ্রেমী ও দরদি হতে সাহায্য করেছিল।

পাকিস্তান অর্জিত হলে তিনি প্রথমে ফরিদপুরে ও পরে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ভক্ত, অনুরক্ত, সাগরেদ। ১৯৪৮ সালেই তিনি বুঝেছিলেন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, মানবিক সমাজ বিনির্মাণে পাকিস্তান এক অনুর্বর ক্ষেত্র; একটি অনন্য বৈরী পরিম-ল। দেশ বিভক্তিতে অসহায় মানুষের জীবন ও ইজ্জত বলিদানের মাঝে তিনি জিন্নাহর তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা দেখতে পেয়েছিলেন। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’— জিন্নাহর এই দম্ভোক্তির মাঝে তিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের কাঠামোয় অন্য জাতিসত্তার অপমৃত্যু, নব্য উপনিবেশবাদের অপছায়া এবং একনায়কের অবয়ব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় অনেক প্রগতিশীলের স্লোগান ছিল— ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’; কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেদিন নিশ্চয়ই শেখ মুজিবের মতো উদার ও মানবিক মনোভঙ্গির মানুষরা উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু ভাষাভাষীর ওপর বাংলাকে চাপিয়ে দিতে চাননি। তারা বাংলা নামক একটি দেশের স্বপ্ন দেখতেন, বাঙালি জাতির কথা ভাবতেন। তাই বাঙালির দেশ বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির ভাষা হিসেবে বাংলাকে চিহ্নিত করেছিলেন। তার আগে ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে শরিক হয়ে কারাগারে নীত হন। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করলে মুচলেকা দিয়ে তিনি ছাত্রত্ব ফেরত নেননি। আওয়ামী মুসলিম লীগের যখন জন্ম হয়, তখন তিনি জেলে। কিন্তু মোশতাক, অলি আহাদ, তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, আবদুল হক ইত্যাকার বড় মাথাকে টপকে শেখ মুজিবকেই পার্টির একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। ১৯৫২ সালে তিনি জেলে থাকলেও ভাষা আন্দোলনের বাঘা নেতারা তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই আন্দোলনের রূপরেখা ও কাঠামো তৈরি করেন। ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাত্যাভিমান ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রচ- নাড়া দেয়। স্বাধিকার অর্জনের স্পৃহাও এখান থেকে জাগ্রত হয়। তখন বাঙালি ও ভিনদেশিদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর হলেও স্বাধীনতার বীজ বপন ও অঙ্কুরিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে বিদ্বেষের বীজ বপন হয়েছিল নির্দ্বিধায় বলা যায়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ জাতীয় স্লোগানের মাঝে এ বীজটিকে স্পষ্ট দেখা যায়। শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার ভাবনায় বিভোর ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডায়েরি থেকে। তিনি পাকিস্তানিদের বলেছেন— ‘তোমরা পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে বৈষম্যের আচরণ বন্ধ কর, নতুবা আমি মরে গেলে পাকিস্তান আর টিকবে না, মুজিব ঠিকই স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। আমি বহু কষ্টে মুজিবকে সামলে রাখছি।’ এ কথা প্রমাণ করে, বঙ্গবন্ধু যদিও স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের কথাই বেশি বলতেন, তবু তার দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তদানীন্তন আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক যুক্তফ্রন্ট থেকে নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হলেও শেখ মুজিব শুধু নির্বাচিতই হননি, দু-দফা মন্ত্রী হন এবং কাগমারী সম্মেলনের পরে পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলেও অসাম্প্রদায়িক দল গঠনের প্রক্রিয়া আগেই তিনি শুরু করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা নয়, স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল। তাই শাসন ক্ষমতায় বসে যুক্তফ্রন্টের স্বায়ত্তশাসন কায়েমের কথা ছিল; কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বড় বেশি পাকিস্তানঘেঁষা ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। তবে মুজিব তেমনটি ছিলেন না এবং আপসের মাধ্যমে যে-কোনো অর্জনপ্রত্যাশী যে তিনি ছিলেন না, তার প্রমাণ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরই পাওয়া যায়। সোহরাওয়ার্দীর মৃৃত্যুর পর মুজিব স্বতন্ত্র ধ্যানধারণা ও আদর্শ নিয়ে আবির্ভূত হন। চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতা ছিল বলেই তিনি মন্ত্রিত্বের মায়া ছেড়ে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, তৎপরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের চালবাজি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং বিভিন্ন অজুহাতে আংশিক ও ১৯৫৮ সালে পরিপূর্ণ সেনাশাসন স্বাধীনতার ভাবনাকে চাঙা করে তোলে। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পড়েই গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাও শাণিত হয়।

১৯৬১ সালে শেখ মুজিব সর্বদলীয় কর্মসূচিতে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার প্রস্তাব সন্নিবেশিত করার জন্য ভিনদলীয় সহকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই বছরে স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে একটি লিফলেট প্রণয়ন ও মুদ্রণ করে তিনি তার বিশ্বস্তজনদের দিয়ে তা বিলি করিয়েছিলেন। একই সময় একটি সশস্ত্র গোপন বাহিনীর নীলনকশাও প্রণয়ন করেছিলেন। বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গোড়াপত্তন তখন থেকেই হয়েছিল; ১৯৬৪ সালের দিকে তার পূর্ণ বিকাশ শুরু হয়। 

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাঝে বাঙালিদের চেতনা আরও তীক্ষ্ণ হয়। ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ স্লোগানসংবলিত মিছিলে শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পূর্বাংশ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা সুস্পষ্ট হয়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ঘোষিত ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা হলেও তাতে যে পূর্ণাঙ্গ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের রূপরেখা ছিল, তা শেখ মুজিব, তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও পাকিস্তানের মসনদে আসীন বা পাকিস্তানের পূর্ব পশ্চিমের সহযোগীরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। ছয় দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি বললেও শেখ মুজিব সঙ্গোপনে বলেছিলেন, ‘ছয় দফা মানে এক দফা’। শুনেছি তিনি হাতের ছয়টি আঙুলকে একত্র করে ঘনিষ্ঠজনদের ছয় দফার বদলে এক দফা বুঝিয়ে দিতেন। এক দফা অর্জনের কৌশল হিসেবে তিনি নিয়মতান্ত্রিক, আধা নিয়মতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপের কথাও চিন্তা করতেন। তবে তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসনের বাণী দিয়ে গণজাগরণ, গণসম্পৃক্ততা সৃষ্টি এবং তাকে বাঙালির একমাত্র প্রবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সে সময় তার অসম সাহসিকতার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তাকে বঙ্গশার্দুল উপাধি দিয়েছিল। 

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করে জনমত গঠনে নামলে তার কপালে জেল, জুুলুম ও নির্যাতন বেড়ে যায়। ছয় দফার আন্দোলনে দেশ যখন টালমাটাল, তখন একদিকে আইয়ুব-মোনায়েম, অপরদিকে পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন নাম ও লেবাসের নেতারা ছয় দফার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বাগযুদ্ধের পর্যায় পার হয়ে সশস্ত্র মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়। সে সালে শুধু শেখ মুজিব নন, অনেক নেতাই জেলে নীত হন। নেতৃত্বের এই শূন্যতা ও আইয়ুব-মোনায়েমের হুংকারে অকুতোভয়ে দাঁড়ানোর জন্য ছাত্রলীগ ও উদীয়মান শ্রমিক লীগই প্রধান ভরসা ছিল। বঙ্গবন্ধু জেলে থেকেই ৭ জুন ছয় দফা দিবস পালনের নির্দেশ দিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে এমনভাবে পরিবর্তন আনা হলো যে, তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও শোষণহীন সমাজচেতনা সুস্পষ্ট হয়।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন হরতাল সর্বাত্মক সফল হলেও আইয়ুব-মোনায়েমের অনুচর এবং তাদের এ দেশীয় ডান-বাম বশংবদদের নির্যাতনে একপর্যায়ে এক নিঃসীম আঁধার বাঙালির জীবনে ঘনিয়ে আসছিল। তখন ৩২ নম্বরের কাছ দিয়ে তেমন কেউ হাঁটত না। শেখ মুজিবের খুব কাছের মানুষরাও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এক নম্বর আসামি করে তাকে যখন সেনানিবাসে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের জন্য জেলখানা থেকে রাতের আঁধারে আনা হলো এবং প্রহসনের বিচার যখন এগোতে লাগল, তখন অনেকেই ভেবেছিল যে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব দুই-ই শেষ হতে আর অল্প সময় বাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যেভাবে সওয়াল জবাব হচ্ছিল, যেভাবে অভিযুক্তদের অনেকে রাজসাক্ষীতে পরিণত হচ্ছিল এবং যে হারে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল তিনি আর কোনোদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারবেন না। ১৯৬৮ সালের দিকে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়ল ঠিকই; কিন্তু শেখ মুজিবকে চাপে কিংবা কৌশলে বা ষড়যন্ত্রে কাবু করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রইল। ছয় দফার বিপরীতে আট দফা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের চাপা ক্ষোভকে প্রশমিত করার চেষ্টা হলো। শিল্প, বাণিজ্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষায় একটু অধিক হারে বাঙালিরা নিয়োজিত হতে লাগল। এরই মাঝে ছাত্রদের আন্দোলন দেশব্যাপী দানা বাঁধতে শুরু করল। আইয়ুব খাঁর উন্নয়নের দশক সমাপ্তির আগেই তার বিরুদ্ধে প্রচ- গণবিক্ষোভ না হলেও প্রচণ্ড ছাত্র বিক্ষোভের আলামত দেখা দিল। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা আন্দোলন প্রচণ্ড গণজোয়ার সৃষ্টি করল। এই এগারো দফার একটি দফায় পুরোপুরি ছয় দফাকে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। এগারো দফার বাতায়বরণে সমাজের প্রতিটি শ্রেণিপেশার মানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের বাসনাকেও ধারণ করা হলো। প্রচ- গণজোয়ার সৃষ্টি হলে আইয়ুব খান গোলটেবিল আলোচনার জন্য শেখ মুজিবকে প্যারোলে লাহোর নিয়ে যেতে সম্মত হলেন। প্রচণ্ড চাপের মুখেও বাঙালিদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নেতা মুজিব প্যারোলে লাহোর যেতে অসম্মতি জানালেন। কোনো ধরনের গোপন চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ বা বাঙালিদের স্বার্থ বিসর্জন দিতে তিনি সম্মত হননি বলে ১৯৬৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি নিঃশর্ত মুক্তি পেলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিশাল সমাবেশে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। উপাধির মাঝেই তার আন্দোলনের অগ্রগতি, লক্ষ্যাভিমুখিতা ও চূড়ান্ত লক্ষ্যের আভাস পাওয়া যায়। একদিন তিনি ছিলেন ‘খোকা মিয়া’। খোকা মিয়া হলেন মুজিবুর মিয়া; মুজিবুর মিয়া হলেন শেখ মুজিব কিংবা শেখ সাহেব; ১৯৬৬ সালে লাহোরে প্রদর্শিত তার সাহসিকতা তাকে বঙ্গশার্দুল উপাধি এনে দেয়। তিন বছরের মাথায় আপসহীন জননেতার স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু পদবিতে তিনি ভূষিত হলেন। 

এবারে তিনি নির্বাচনপ্রত্যাশী হলেন। নির্বাচনের আগে গোলটেবিলে যোগদান যেমন ছিল একটি কৌশল, এলএফও মেনে নির্বাচনে যাওয়াটাও ছিল তার অপর একটি কৌশল। এলএফও-র মূলকথা ছিল নির্বাচনি প্রচার কিংবা পরবর্তী শাসনতন্ত্র রচনায় পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিকে দুর্বল করা যাবে না; অথচ ছয় দফা ছিল তেমনই একটি দলিল। নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ছয় দফাকে আরও জনপ্রিয় এবং নিজকে ও দলকে বাঙালির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগেই যে তিনি বাঙালির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা ছিলেন, তা নির্বাচনে গিয়েই প্রমাণ করলেন। ছয় দফাভিত্তিক সরকার গঠিত হলে সেনাসদর না হোক অন্তত নৌবাহিনীর হেডকোয়াটার্স বাংলাদেশে হতো, সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রে বাঙালিদের সংখ্যা একলাফে বেড়ে যেত এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে প্যারামিলিশিয়া গঠনের সুযোগ আসত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তখন শুধু এক ঘোষণায় কিংবা নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিনা রক্তপাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো। তাই শুধু নির্বাচনই নয়, সরকার গঠনের ইচ্ছাটাও তার চূড়ান্ত লক্ষ্যাভিমুখী কর্মসূচির পরিপূরক ছিল। বোধকরি এই ইচ্ছাটা তার মনে ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল। নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে শর্তসাপেক্ষে বিদেশি মুরুব্বিদের সায়ও ছিল। কিন্তু সেদিন বিকালেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা বন্ধক অবাঞ্ছিত। রক্তের দামেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এ কারণেই হয়তো সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আগামীকাল যদি ইয়াহিয়া খান কোনো ঘোষণা দেয় বা ভাষণ দেয় এবং সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয়, তাহলে বুঝবে রক্তাক্ত যুদ্ধ ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না।’ অবশ্য ১ মার্চের ভাষণের পর ইয়াহিয়ার পাকিস্তানিরা যেমন ক্র্যাকডাউনের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিল, বাঙালিরাও তা শুধু মোকাবিলা নয়, আঘাতের বদলে প্রতিঘাত এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বৈষয়িকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৯৬১ সালেই শেখ মুজিব অতিসঙ্গোপনে স্বাধীনতার আহ্বানসংবলিত যে লিফলেট বিতরণ করেছিলেন, সেই স্বাধীনতাই সশস্ত্র পন্থায় অর্জনের পথ খুলে দিল ২৫ মার্চের মিলিটারি ক্র্যাকডাউন। বঙ্গবন্ধু হঠকারিতার কী পরিণাম, তা জানতেন বলেই তিনি চটজলদি আস্সালামু আলাইকুম বলেননি, স্বনামে লিফলেট ছাড়েননি কিংবা ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার ঘোষণা দেননি। যে স্বপ্নের বাস্তবায়নের অপেক্ষায় তিনি ছিলেন, ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে তিনি সরাসরি ঘোষণা দিলেন। অবশ্য এ ঘোষণাটা ছিল বিশ্ববাসীর জন্য। এর পরের যুদ্ধটা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মাটি উদ্ধার, বাঙালিত্ব কায়েম, শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। যুদ্ধের কৌশল ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা তিনি ৭ মার্চের ভাষণে পরিষ্কার তুলে ধরেছিলেন এবং সেটা ছিল সব বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৫-এর রাতে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার আগে তিনি অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, ২৪টি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম ও গণদীক্ষার মাধ্যমে তিনি এমন বাঙালি জাতি সৃষ্টি করলেন, যারা ৯ মাসের যুদ্ধে একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি, একবারও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। হাসিমুখে তিরিশ লাখ তাজা প্রাণ বিসর্জিত হলো; প্রায় চার লাখ মা-বোন ধর্ষিত হলেন; এক কোটি মানুষ দেশান্তরী হলেন; কোটি কোটি মানুষ স্বদেশে পরবাসী হয়েও গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী পরিমণ্ডল বানিয়ে রাখলেন। সুদীর্ঘ ৯ মাস পরে যখন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করল ও বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলো, তখনও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই সারা জাতি পতাকা, মানচিত্র ও মাটিতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য সত্তা দেখল এবং তারই প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় প্রহর গুনল। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালেই আমাদের চোখ ও কানসহ সবক’টি ইন্দ্রিয় তৃপ্তির আনন্দে উদ্ভাসিত হলো। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মীরা পরিচালনা করেছিলেন ঠিকই; কিন্তু যুদ্ধটা পরিচালিত হয়েছিল তারই শিক্ষায়, তারই দীক্ষায় এবং তারই নির্দেশনায়। বিশ্বের তাবত সর্বাধিনায়কের মতো তার অবস্থান ছিল মাঠের বাইরে, যোদ্ধাদের মন-মননে ও জাগ্রত চেতনায়। তাহলে একটি অনুমান সত্যি হলো যে, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পেছনে একটি ধারাবাহিকতা আছে। এই ধারাবাহিকতা তৈরি করেছে একটি মুহূর্তের অনিবার্যতা; সৃষ্টি করেছে ঘটনাবলির অপ্রতিরোধ্যতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আছে। এই ধারাবাহিকতা থেকে তৈরি হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অসহযোগ-প্রতিরোধ উদ্ভূত অনিবার্যতা, যে অনিবার্যতা তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ্য এবং একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের কার্যক্রম। 

—অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

মুক্তিসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা

ভিসি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

SUMMARY

573-1.jpg