হাসানুর রশীদ
মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হলেও মূলত বঙ্গবন্ধুর গভীর একনিষ্ঠতায় বিভিন্ন জেলায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড প্রাণ পেতে থাকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার অনুগত নেতাকর্মীদের সুনজরে দেখেননি। ফলে শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ও উদারপন্থি নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম লীগের পুরানো কমিটি ভেঙে দিয়ে মওলানা আকরম খাঁকে আহ্বায়ক করে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই কমিটি প্রত্যেক জেলায় ৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয়। জেলা কমিটিগুলোতেও সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ও মুসলিম লীগের উদারপন্থি নেতাকর্মীরা স্থান পাননি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—
‘তিনি পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে একটা এডহক কমিটি গঠন করলেন। পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছিল; কিন্তু পাঞ্জাব মুসলিম লীগ ভাঙলেন না। সীমান্ত প্রদেশও না, একমাত্র বাংলাদেশ। কারণ এখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থক বেশি। তাই নতুন করে লীগ করতে হবে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থক দিয়ে। ...আমরা তাড়াতাড়ি একশত বারোজন কাউন্সিল সদস্যের দস্তখত নিয়ে একটা রিক্যুইজিশন সভা আহ্বান করার দাবি করলাম। ...আমি ঘুরে ঘুরে দস্তখত সংগ্রহ করলাম। ...মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের কাছে পৌঁছাতে হবে এই নোটিশটি। ...আমি তাকে সালাম করে তার হাতে নোটিশটা দিলাম। ...পরেরদিন আজাদ কাগজে তিনি নোটিশটি এবং যারা দস্তখত করেছে তাদের নাম ছেপে দিলেন এবং বিবৃতি মারফত ঘোষণা করলেন যে, রিক্যুইজিশন সভা আহ্বান করার ক্ষমতা কারও নাই, কারণ পুরানা প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেয়া হয়েছে। এখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের এডহক কমিটির সভাপতি। অর্থাৎ আমরা কেউই আর মুসলিম লীগের সভ্য নই। এভাবে মুসলিম লীগ থেকে আমরা বিতাড়িত হলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড)।
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নেতাদের দলকে পকেটস্থ করার এই নিন্দনীয় আচরণের পরও সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ও উদারপন্থি অংশ দলকে দ্বিখখিন্ড না করার প্রত্যয়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫০ মোগলটুলি কার্যালয়ে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প করে অ্যাডহক কমিটি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের একত্রিত ও তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে তারা অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে দেখা করে তাদের দলের রশিদ বই দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে যোগ দেওয়া নেতাকর্মীদের তিনি মুসলিম লীগবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের রশিদ বই দিতে অস্বীকার করেন।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতাদের এ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ও উদারপন্থি নেতাদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিকল্প ছিল না। কিন্তু সে সময় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করা সহজ ব্যাপার ছিল না। কারণ মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা তো ছিলেনই, দেশভাগের পূর্ব সময় থেকে শহর-গ্রাম-গঞ্জের মসজিদ-মক্তবে ইমাম-মুয়াজ্জিন, মওলানা-মুনশি— সবাই প্রচার চালিয়ে পাকিস্তানকে বাঙালি জাতির স্বপ্নের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবগঠিত পাকিস্তানের প্রতি প্রায় সব বাঙালি মুসলমানের প্রবল ভালোবাসা গ্রন্থিত ছিল। মুসলিম লীগের দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব সেটা শুধু উচ্চপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ব্যাপার ছিল। সে অন্তর্গত বিরোধের স্বরূপ এবং সে কেন্দ্রিক হীনম্মন্যতার কথা বৃহত্তম বাঙালি মুসলিম সমাজের জানা থাকার কথা নয়। কাজেই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কলকাতা ফেরত বা ঢাকায় কোনো নেতার পক্ষে পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের সুবিধাবাদী নেতাদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব ছিল না।
পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সরকার দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। দলীয় নেতাকর্মী ও তাদের স্বজনদের দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। সরকার বাংলা ভাষার বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছিল। আবার ১৯৪৯ সালে ভয়াবহ খাদ্যসংকট দেখা দেয়। বিরোধী মতাবলম্বীদের নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রাও সীমা ছাড়িয়ে ছিল অনেকখানি, যা সচেতন বাঙালিসমাজ কখনোই সমর্থন করে না। এ রকম অসংখ্য কারণে ’৪৭ থেকে ’৪৯— এই দুই বছরে ক্ষমতাধিষ্ঠিত নেতাদের জনপ্রিয়তা অভাবিতভাবে কমে যায়। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বকাল থেকেই পূর্ববঙ্গে খাজা নাজিমউদ্দিন এবং তার রক্ষণশীল গ্রুপের নেতাকর্মী-সমর্থকের চেয়ে সংখ্যায় সোহরাওয়ার্দী ও তার গ্রুপের নেতাকর্মী-সমর্থক অনেক বেশি ছিল। সোহরাওয়ার্দীই পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। সে কারণে বলা যায়, ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা ধসের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট সরকারবিরোধী জনমনোভাব কাজে লাগিয়ে এবং অ্যাডহক কমিটিতে পদবঞ্চিত সোহরাওয়ার্দী সমর্থিত সমন্বয়ে ১৯৪৯ সালের দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের একটি উর্বর ক্ষেত্র বাংলায় যথার্থভাবে প্রস্তুত হয়েছিল।
শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন তরুণ নেতার আন্তরিক প্রচেষ্টায় একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ হয়। মওলানা ভাসানীর মতো নেতাও তারা পেয়ে যান। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ঢাকার রাজনৈতিক জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে ১৯ এপ্রিল তাকে কারাগারে চলে যেতে হয়। তার কারাবন্দি অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনের অল্প কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু কারামুক্তি লাভ করেন। তারপর তিনি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা গঠিত মুসলিম লীগের অ্যাডহক কমিটিতে পদবঞ্চিত সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ও উদারপন্থি চেতনার হাজার হাজার ত্যাগী ও পুরানো নেতাকর্মীকে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগে’ যুক্ত করার কাজে আত্মনিবেদন করেন। তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঞ্চলিক কমিটি গঠন হতে থাকে। মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হলেও মূলত বঙ্গবন্ধুর গভীর একনিষ্ঠতায় বিভিন্ন জেলায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড প্রাণ পেতে থাকে।
স্বভাবতই ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতারা প্রসন্ন মনে গ্রহণ করেননি। তাই প্রথম থেকে তারা সদ্যোজাত এ সংগঠনটিকে গলা টিপে হত্যার পরিকল্পনা করে। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন শুরু হয়। স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘যো আওয়ামী লীগ করেগা, উসকো শের হাম কুচাল দেগা।’ কাজেই আওয়ামী মুসলিম লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও মুসলিম লীগের স্থানীয় গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয়। তারা সংগঠনটির কর্মকাণ্ড ও প্রচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তেমন একটি ঘটনার ভাষাচিত্র প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে এভাবে অঙ্কন করেছেন—
‘কাজেই ১৯৫০ সালে মওলানা ভাসানী ও শহীদ সাহেব আওয়ামী লীগ সংগঠনে যখন ময়মনসিংহে আসিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের ‘লাঠি’ জনাব আবদুল মোনেম খানের নেতৃত্বে শহরের মুসলিম লীগ কর্মীরা একেবারে ক্ষিপ্ত। ময়মনসিংহে নেতৃদ্বয় আসিতেছেন শুনিয়া অবধি স্থানীয় মুসলিম লীগ কর্মীরা স্বয়ং মোনেম খান সাহেবের ব্যক্তিগত নেতৃত্বে মাইকে পোস্টারে এই বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রদ্ধেয় নেতার বিরুদ্ধে অশ্লীল কটুকাটব্য শুরু করিলেন। শেষ পর্যন্ত গুণ্ডামি করিয়া আমাদের সভা ভাঙ্গিয়া দিলেন।’
সরকারের গ্রেপ্তার ও কারান্তরালের অত্যাচার-নির্যাতন এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নেতারা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সাহসী ভূমিকা নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা করে তোলে। সেই প্রতিকূল অবস্থায় দলটির অস্তিত্ব ও কর্মতৎপরতা সবলে জানান দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে ১৯৪৯ সালের ১৮ অক্টোবর এক জনসভা আহ্বান করা হয়। তবে সভাটি শুরুতেই পুরান ঢাকায় মুসলিম লীগের পালিত গুন্ডাদের আক্রমণে পড়ে। তারা সভার চেয়ার-টেবিল এলোমেলো ও ভাঙচুর করে। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নেতাকর্মী তাদের বিতাড়ন করে সভার কার্যক্রম শুরু করেন।
সে সময় দেশের খাদ্যসংকট প্রবল রূপ ধারণ করেছিল— দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। হাজার হাজার মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যেতে থাকে। একমাত্র খুলনা জেলায়ই সরকারের অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে ২৫ হাজার মানুষ মারা যান। অথচ সরকার খাদ্য সমস্যা সমাধান না করে ক্ষমতা পোক্ত করতে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দুর্নীতি প্রতিপালনে ব্যস্ত ছিল। তাই ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে দ্রুত খাদ্যসংকট নিরসনে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সভায় নেতারা সরকারের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেন, খাদ্যসংকট দ্রুত অবসান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন এবং সভা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে একটি ভুখা মিছিল বের করা হয়।
সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ঢাকার গভর্নমেন্ট হাউজে অবস্থান করছিলেন। নেতারা খাদ্যসংকট দূরীকরণে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে ভুখা মিছিল নিয়ে সেদিকে যাত্রা শুরু করেন। মিছিলটি নাজিরাবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে এলে পুলিশ মিছিলকারীদের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশের লাঠির আঘাতে আবদুল ওয়াদুদ, জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মফিজুল্লাহসহ অনেকে গুরুতর আহত হন। সেখান থেকে পুলিশ মওলানা ভাসানী, শামসুল হকসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। তবে সে সময় বঙ্গবন্ধুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে ১৯৪৯ সালের ১৮ অক্টোবর এই জনসভায় বিপুল জন-উপস্থিতি ও সম্পৃক্ততা সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে। ভুখা মিছিলের ব্যাপ্তিও সরকারকে ভাবিত করে। ফলে সরকার প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মকা- থামিয়ে দিতে অধিকতর তৎপর হয়ে ওঠে। দলটির নেতাকর্মী-সমর্থকদের গণহারে গ্রেপ্তার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সে সময় পুলিশের তৎপরতা এড়িয়ে আত্মগোপনে চলে যান এবং গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সে সময় পার্টির শুভাকাক্সক্ষী অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুকে তারা ঢাকার রাজনৈতিক অবস্থা যে-কোনো উপায়ে সোহরাওয়ার্দীকে জানানোর পরামর্শ দেন।
সে সময় সোহরাওয়ার্দী লাহোরে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত হয়ে গোপনে লাহোর যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সরকারবিরোধী কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তুলে ধরেন। এছাড়াও সেখানে তিনি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রয়াস চালান। তিনি গোলাম মোহম্মদ খান নুন্দখোর, নবাব মামদোত, পির মানকি শরিফ, সর্দার আবদুুল গফুর, সর্দার সেকেন্দার, শামিম জংসহ অনেক নেতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এবং নিখিল পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তাদের পরামর্শে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নির্যাতনের স্বরূপ উল্লেখ করে পত্রিকায় বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সেখানেও গোয়েন্দারা তার পিছু নেয়। ফলে গ্রেপ্তার আতঙ্ক মাথায় নিয়ে বেশিদিন সেখানে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি মাসখানেক লাহোরে থাকার পর ঢাকায় ফিরে আসেন এবং গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন। এ অবস্থায় ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পুরান ঢাকার খাজে দেওয়ানে অবস্থানকালে বাড়িওয়ালার ভাগ্নের চক্রান্তে তিনি গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়।
১৮ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর থেকে মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক ঢাকা জেলে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে ঢাকায় আগমনের পর তৃতীয় দফার জেলজীবন শুরু করেন। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় কলকাতা ও বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। কুচক্রীরা রটিয়ে দিয়েছিল যে, কলকাতায় হিন্দুরা শেরেবাংলাকে হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়, ঢাকা ও বরিশালে কিছু উগ্র মুসলিম হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক হতাহত হয়।
এ সময় সরকারের পুলিশি নির্যাতন সীমা অতিক্রম করে। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর প্রায় সব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেকে কমিটি থেকে পদত্যাগ করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। কারাগারেও রাজবন্দিদের ওপর চলে নির্যাতন। ঢাকা জেলে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শামসুল হক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের পরিমাণমতো ও উপযুক্ত খাদ্য দেওয়া হতো না। ১৯৪৯ সালে কমপক্ষে দুইশ দিন রাজবন্দিরা অনশন করেন। ঢাকা জেলের রাজবন্দি শিবেন রায় অনশনে মারা যান। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্দি আন্দোলন ঠেকাতে ১৯৫০ সালে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘটে লোমহর্ষক ঘটনা। সেখানকার খাপড়া ওয়ার্ডের একটি কক্ষে এনে গুলি করে সাতজন রাজবন্দিকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। এর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে গ্রেপ্তার ও কারাবাস বঙ্গবন্ধুর অবিছেদ্য নিয়তি হয়ে ওঠে।
‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর নেতাকর্মীদের সেই দুঃসময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন। তিনি নিজ উদ্যোগে রাজবন্দিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। তার প্রচেষ্টায় মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক মুক্ত হন। তবে সে সময় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। অপ্রতিরোধ্য সাহসিকতার কারণে তিনি সে সময়ই শাসকদের মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক ভূমিকাকে খুবই ভয় পেতেন। তিনি জানতেন, বঙ্গবন্ধু মুক্ত থাকলে সরকারের সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এর কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে সফল হবেন। তাই অসংখ্য নেতা ও ছাত্রনেতাকে বাইরে রাখতে সাহস পেলেও বঙ্গবন্ধুকে তিনি কারাগারের বাইরে রাখতে সাহস করেননি।
—হাসানুর রশীদ, লেখক ও গবেষক