হাবীবুল্লাহ সিরাজী
সবুজের মায়া এবং পলির স্নেহে গড়া এই বাংলাদেশে পরম শ্রদ্ধাভরে যার নামটি উচ্চারিত হয়, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির জাতির জনক। একটি দেশের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের মানদণ্ডে তার ভাষা যখন নিদারুণ সংকটের মধ্যে আবর্তিত হয়; তখন চেতনায় সংগ্রামের রূপরেখা একরৈখিক হয়ে পড়ে। আর এ একরৈখিকতা কেবল সার্বিক মুক্তির মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত বিজয়ের পথ দেখে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবস্থানে যে আঘাত প্রকটভাবে নাড়া দিল, তা তাদের ভাষা। এ ভাষা সংগ্রামের সূত্র থেকেই পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ক্রমেই বিভেদের উপপাদ্যে যুক্ত হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসামঞ্জস্য। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই এ অঞ্চলের বাঙালিরা তথাকথিত পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখায় অনাস্থা প্রকাশ শুরু করেন।
সংগ্রাম, নির্বাচন এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যে এক নব আখ্যানভাগের সূচনা হয়, তারই অগ্রভাগে চলে আসেন তরুণ প্রাণ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকে আমাদের অধিকার আদায়ের মৌলিক উপাদান ছিল ৬ দফা।
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি এমন এক নাম যার অভ্যন্তরে বিরাজ করে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সুনাম। আজ ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে তাকে কীভাবে দেখি কিংবা কীভাবে দেখব? জাতি হিসেবে আমাদের যত গৌরবই থাক, মীরজাফরও আমাদের পায়-পায় ঘোরে। প্রতিটি ন্যায়যুদ্ধেই আমরা লক্ষ্য করেছি তাদের নীরব অথবা সরব উপস্থিতি। কখনও পেছনে, কখনও পাশে আবার কখনও বা সম্মুখে চলে আসে তাদের ষড়যন্ত্রের কলাকৈবল্য।
স্বাধীনতার পর থেকেই নানা আবরণে, নানা মাত্রায় তারা দেশটির পেছনে লাগল। আর চরম আঘাত হানল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এক বাঙালির রক্ত সিঁড়ি ধুয়ে নেমে এলো জনপথে, সবুজ প্রান্তরে, নদী-নালা অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে। বঙ্গবন্ধুর কি অবসান হলো? না, তিনি যে কোটি হৃদয়ের শিশিরের ফোঁটা, সূর্যের শিখা।
তার কাছে কী আশা করেছিল বাঙালি? একটি দেশ। আমরা পেয়েছি। পলিবিধৌত এ জনপদে নিজেকে পরিপূর্ণ পরিচালনার অধিকার এই তো প্রথম। ভাষার দাবি থেকে শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই যে অর্জন, তা কেবল সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্বের জন্য।
জীবনবাজি রেখে দেশবাসীকে ভালোবাসার জন্য। মানুষকে ভালোবাসা কি অন্যায়? স্বজাতির জন্য জীবনদান কি বৃথা? স্বপ্ন দেখা কি অপরাধ? না। তা হলে কেন এ বিপর্যয়, কেন এ নগ্ন অভিসার? আছে, কারণ আছে। থাকতেই হয়। আদমের সঙ্গে যে ইবলিশ ঘোরে! আমাদের প্রতিটি জয়ের পেছনে খড়গ নিয়ে অপেক্ষা করে পরাজয়। তবু আমরা ভয় তো পাই না। মানুষের জন্য সামান্যতম ত্যাগও অসামান্য হয়ে ফিরে আসে। রক্তের ঋণ তো আমাদের জন্ম থেকেই, আর তার পরিশোধের ভাষা রক্তের বর্ণেই লিপিবদ্ধ হয়।
বঙ্গবন্ধু তার জীবনাচরণে তা-ই আমাদের শিখিয়ে গেছেন। সময়কে তিনি সততার সঙ্গে ধারণ করেছিলেন, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন পরিস্থিতি; সর্বোপরি বিবেচনায় নিয়েছেন মানুষের অগ্রযাত্রা। তাই তো চল্লিশের দশকের মুজিবুর, পঞ্চাশের দশকের শেখ মুজিবুর রহমান, ষাটের দশকের বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে জাতির জনক। তার বিশ্বাসের স্থানগুলোয় তিনি চেয়েছেন মজবুত ইমারত। স্বপ্ন এবং বাস্তবকে মিলমিশ করে শ্রেণীহীন এক সমাজের চিত্র ছিল তার মানসপটে। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক অভিযাত্রার তার যে উদ্যোগ, তা ছিল যুগান্তকারী। পরিতাপের কথা, কর্মভোগ তা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিল। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর ভাবনাই আমাদের মুক্তির দলিল। যে পথে তিনি ছিলেন, সেখানেই রথের মূল চাকা।
সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুইটি আমাদের সামনে বঙ্গবন্ধু-চরিত্রের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত করেছে। একজন ত্যাগী ও দেশপ্রেমী মানুষের আন্তঃভুবনের সংবাদ যেন সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে বিধৃত। তার সারা জীবনের স্বপ্নই ছিল কৃষক-মেহনতি মানুষের কল্যাণ। রক্তের বিনিময়ে তাই তো তিনি বাংলার মানুষের কাছে তার ভালোবাসার ঋণ শোধ করলেন। গৌরবের সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ হলো সেই মহামানবের নাম : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।