বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এসবে হবে না চাই স্বাধীনতা

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ভাবনা বেশ আগে থেকেই ছিল। এটা বলার কারণ হলো তিনি আমাকে ১৯৬৪ সালে বলেছিলেন, সাইয়িদ এসব দিয়ে আমাদের হবে না। আমাদের স্বাধীনতা লাগবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এ কথোপকথন রাজশাহীতে। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা। বঙ্গবন্ধু রাজশাহীতে আসেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নিতে। তখন বঙ্গবন্ধুকে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল না দেয়ায় আমরা বিক্ষোভ করলাম। ইপিয়ার আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করল। এতে আমাদের অনেকেই আহত হলো। এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে এ কথা বলেছিলেন। আসলে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই এবং তিনি সেটা সারা দেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির কাছে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে। বিশেষ করে ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং এ মামলা-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে উদগ্রীব হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে বোঝাতে পেরেছিলেন পাকিস্তান শাসকের ষড়যন্ত্র থেকে বাঙালির মুক্তি নেই। সে লক্ষ্যে তিনি ছয় দফা দাবির মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। এ আন্দোলন ছিল আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আদর্শ, মূল্যবোধ ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালির এ অধিকার ভাষার অধিকার, স্বশাসনের অধিকার। শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা নির্মাণের প্রত্যয়ে এ আন্দোলনগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল। সে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিকে জাতিসত্তা নির্মাণের ডাক দেন এবং  একইসঙ্গে জাতীয় পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করেছেন। 

একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য তিনি সারাজীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আপসহীনভাবে লড়াই-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ধর্মান্ধতার আবরণে পরিচালনা হয়েছে। যে রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক স্বৈরশাসন, মানুষের সমঅধিকারের পরিবর্তে স্বৈরশাসন এবং সুশাসনের পরিবর্তে সামরিক শাসন, নির্যাতন বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়; বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি মেলে। বাঙালি জাতি উপলব্ধি করতে পেরেছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে ধনী, বণিকের স্বার্থ, আমলাতান্ত্রিক স্বৈরাচার বাঙালিকে বঞ্চিত করে রেখেছিল বছরের পর বছর। পাকিস্তানের তথাকথিত নেতারা ছলে বলে কৌশলে বাঙালিকে শাসনের নামে শোষণ করেছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থা থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্যকে দৃশ্যমান করে।

কিন্তু এ স্বাধীনতার স্বাদ আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। ১৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে সেটা মুছে দেয়া হয়। এটি নিছক কোনো হত্যাকা- ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ব্লু-প্রিন্ট। কারণ ঘাতকরা জানত বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে না পারলে দক্ষিণ এশিয়ায় যে নতুন ধরনের গণমুখী রাজনীতির সূত্রপাত হয়েছিল তা পশ্চিমাদের চিরায়ত শোষণ প্রক্রিয়া এবং শাসন ব্যবস্থাকে মরণঘণ্টা বাজিয়ে দিত। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছাড়া আর তাদের কোনো বিকল্প ছিল না। জাতীয় আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ম্যাধমে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বপ্ন আকাক্সক্ষা ও রাষ্ট্রের চার মূলনীতিকে আঘাত করে তাকে ধ্বংস করে। এ হত্যাকা-ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। 

SUMMARY

560-1.jpeg