গণমাধ্যম ও বঙ্গবন্ধু

মো. আবদুল কুদ্দুস

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রম, অবদান ও ত্যাগ অসীম। সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি- সবাই বঙ্গবন্ধুর দুর্দান্ত নেতৃত্বের ছায়াতলে থেকে আন্দোলন-সংগ্রামকে করেছেন বেগবান। সেজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির আদর্শ। বঙ্গবন্ধু বাঙালির সব কাজের অনুপ্রেরণায়, চেতনায় ও পথ চলায়। তাই এ মহান নেতার শহীদি আত্মার স্মরণে আগস্ট বীর বাঙালি জাতির কাছে শোকের মাস। 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অমর সৃষ্টি প্রথম গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় গণমাধ্যমের প্রতি গভীর আগ্রহ ও বিশ্বাসের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। কেননা বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসীম। এ মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে শুধু ‘সংবাদ মাধ্যম’ না ভেবে ‘গণমাধ্যম’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ওই গ্রন্থগুলোয় তার লেখনীর মাধ্যমে তিনি শুধু গণমাধ্যমই নয়, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের কথা স্মরণ করেছেন গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধাভরে। ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের অবদান, ছয় দফা দাবিকে ‘মানুষের বাঁচার দাবি’ হিসেবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদানের কথাও তিনি তার দুইটি গ্রন্থে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনই মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করেই আমি এবারের শোক দিবসে অর্থাৎ জাতির পিতার ৪২তম মহাপ্রয়াণ দিবসকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের প্রতি গভীর মমত্ববোধের কথা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি-
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে গণমাধ্যমের গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে একবার বলেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ. ১০)।’ এরপর তিনি তুলে ধরেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণমাধ্যম রাজনীতির কথা এবং সেই সময় এ অংশের নেতাদের জনগণের কল্যাণে নেয়া পদক্ষেপের ইতিহাস। তিনি তার এ দুইটি গ্রন্থে তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মালিক ও তাদের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন খোলাখুলিভাবে। কখনও কোনো পত্রিকার প্রশংসা করেছেন। কখনও আবার ক্ষেত্রবিশেষে কোনো পত্রিকার ভূমিকাকে নিন্দা করতে ছাড়েননি তিনি। এ নেতা বলেন, ‘চল্লিশের দশকে দৈনিক আজাদ ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ওই একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে জনাব মোহাম্মাদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমান দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক) এবং আরও দুই-একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করতেন। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা সংবাদ ছাপাতেন। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ওই পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত, তবু ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণী বলা যায়।... আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারা প্রচার করার জন্য।... হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে, তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এ দুইজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব- এ ধারণা অনেকেরই ছিল। আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাতখরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছুই না দিলেও চলবে। আরও দুই-একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। ...বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৪০)।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনীতির খবরাখবর নিতে ভরসা রাখতেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর। তিনি তার জীবনের কঠিন সময় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে।  
গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে সাহায্য করেছিল, তা-ও তিনি লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি বলেন, ‘নওয়াই ওয়াক্ত, পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ও অন্যান্য কাগজে আমার প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য খুব ভালোভাবে ছাপিয়েছিল। সরকার সমর্থক কাগজগুলো আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনাও করেছিল। আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যার ওপর বেশি জোর দিয়েছিলাম।’ (পৃ. ২১৮)।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের এক তিল পরিমাণ অবদানও স্বীকার করতে ভোলেননি। তিনি গণমাধ্যমের পাশাপাশি গণমাধ্যম পুরোধা ব্যক্তিত্বদের অবদান লিখে রেখেছেন স্বর্ণাক্ষরে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ইয়ার মোহাম্মাদ খান আমাকে সাহায্য করতে লাগলেন। তার সমর্থন ও সাহায্য না পেলে খুবই অসুবিধা ভোগ করতে হতো। মানিক ভাই ইত্তেফাক কাগজকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সাপ্তাহিক কাগজ হলেও শহরে ও গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান অবজারভার কাগজও আমাদের সংবাদ কিছু দিত।’ (পৃ.২৩৭)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আরেকটি কালজয়ী গ্রন্থ কারাগারের রোজনামচায় গণমাধ্যমপ্রীতির কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তিনি এ গ্রন্থে কারা-অভ্যন্তরীণ জীবনের ২ বছরের (১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭) ঘটনা ডায়েরি করে লিখে রেখেছেন। তার এ ডায়েরিতে (পৃ. ৬২) তিনি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর নানা অত্যাচারের কথা এবং ইত্তেফাক পত্রিকা অন্যায়ভাবে বন্ধ করে দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করার কথাও বলেছেন। এরপর তিনি (পৃ. ৮৪-৮৫) লিখেছেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার বাজেট পেশ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর কীভাবে করের বোঝা চাপিয়েছিল, তার ইতিহাস।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৭৬)।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, যুক্তফ্রন্টের প্রণীত ২১ দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ইত্যাদিকে তৎকালীন গণমাধ্যম জনগণের প্রাণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই ১৯৭৪ সালে স্বাধীন গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রেস কাউন্সিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনে গণমাধ্যমের প্রভাব রয়েছে বলা যেতে পারে। তিনি নিজে যেমন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি অন্যদের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছেন। পৃথিবীর কোনো নেতা এমন করে গণমাধ্যমের প্রতি ভরসা রেখে জনগণের কল্যাণে ও দেশের মুক্তি সংগ্রামে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অগ্রে রেখেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

মো. আবদুল কুদ্দুস
শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী

SUMMARY

555-1.jpeg