বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক


ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার জন্য যুদ্ধ করেছি। সোনার বাংলা শব্দের অর্থ সোনা দিয়ে মোড়া বাংলা নয়। তার অর্থ হচ্ছে কমপক্ষে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, রোগশোক ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি মানবিক দেশ। এ মানবিক দেশে সব মানুষ খাবার পাবে, শিক্ষা পাবে, চিকিৎসা পাবে, বাসস্থান পাবে, কেউ কারও বাড়িঘর শুধু ধর্মীয় কারণে পুড়িয়ে দেবে না
বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংজ্ঞা অর্থাৎ ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ বিরাজমান। একটু পেছনে গিয়ে কথাটার যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করব। ৪৭ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলেও প্রতিক্ষণেই আমাদের শুরুতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছি, যার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সে সময় আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেসবের অনুশীলন হতো। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আমরা হাজার বছরের বাঙালি থেকে বাংলাদেশী হয়ে গেলাম। এখন সারা বিশ্বে ২৫ কোটির বেশি বাঙালি থাকলেও মনে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া বিশ্বে বাঙালি আর কোথাও নেই। বাংলাদেশে বাঙালিরা এখন বাংলাদেশী, আর ভারতে বসবাসকারী বাঙালিরা হলেন ভারতীয়। বাঙালির বদলে বাংলাদেশী হওয়ার শানেনজুল হচ্ছে অনেক কিছু, তবে ভারতকে আশ্বস্ত করার একটা প্রবণতা তাতে ছিল বলে অস্বীকার করার জো নেই। যাক, হাজার বছরে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার যে ভিত্তি গড়ে উঠেছিল এবং যে জাতি বাঙালি হিসেবে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনল, তারা মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পরিচিতি হারিয়ে ফেলল- যার পুনরুদ্ধার অনুকূল পরিবেশেও সম্ভব হলো না। সান্ত্বনাসূচক বাণী শুনি, ‘আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি, চাকমা, গারো ইত্যাদি; কিন্তু আমাদের নাগরিকত্ব হলো বাংলাদেশী।’ 
তারপর আমরা যা হারালাম তার মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ বিমান। বিভিন্ন পর্বে পাকিস্তানি নামের সঙ্গে সংগতি রেখে এসবের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংস্কার করা হলো। আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে হারালাম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। অপবাদ দেয়া হলো এই জয় বাংলা হিন্দুঘেঁষা আওয়ামী লীগের স্লোগান এবং জয় হিন্দের মতোই মনে হয়। তাই আমরা জয় বাংলা থেকে অফিসিয়ালি বাংলাদেশ জিন্দাবাদে ফিরে গেলাম। জয় আর জিন্দাবাদ সমার্থক; কিন্তু জয় বাংলা হলো মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি আর জিন্দাবাদ হলো পরাধীনতার স্মারক, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজদের পূর্বাভাস। মুক্তিযুদ্ধকালে সব যোদ্ধা ‘জয় বাংলা’ বলে লড়ছিলেন এবং এ কে খন্দকারের মতো লোকও বলেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের একে অপরের সাক্ষাৎ হলে বলতাম ‘জয় বাংলা’। 
মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা যেখানে প্রশিক্ষণ নিতাম, সে জায়গাটা পাকিস্তান সীমান্ত থেকে বেশি দূরে ছিল না। আমরা ট্রেনিংকালে অতি উচ্চৈঃস্বরে জয় বাংলা স্লোগান দিতাম। মুলতান বেতার থেকে একদিন সে কথা জানিয়ে দেয়া হলো। এরপরও জয় বাংলা যে আওয়ামী লীগের নয়, গোটা যোদ্ধা জনতার রণধ্বনি, তা আবারও ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনকালে ১৯৯২ সালে প্রমাণিত হলো। সেদিন হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সামনে জামায়াত-শিবির যুবকমান্ডের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ বেধে গেল। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতকবিরোধীরা দলমত নির্বিশেষে সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে শুরু করল এবং আমরা প্রতিপক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের সংঘটিত করতে পেরেছিলাম। অবশ্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনে আমরা জয় বাংলা স্লোগানটি শেষ দিন পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে পারিনি। 
১৯৭৫ সালে আমরা হারালাম আমাদের জাতিগত পরিচয়, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র। তারপর সংবিধানে যে আকারে আমরা তাদের পুনরুত্থান দেখলাম, সে রূপের জন্য ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়নি; ৪ লাখ মা-বোন ইজ্জত-আব্রু হারায়নি; ১ কোটি মানুষ পররাজ্যে আশ্রয় নেয়নি; কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবন কাটায়নি। সত্যিকার অর্থে আমাদের চার নীতির সামান্য পরিবর্তন করতে হলেও প্রথমে শহীদ ও ধর্ষিতাদের ফেরত পেতে হবে। সেটা যখন সম্ভব নয়, তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অবিকৃত থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এসব অবিকৃত রাখার পাশাপাশি ঘাতক নির্মূলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বলেই আইনগতভাবে তাদের নির্মূল সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে। 
১৯৭৫ সালের পর অনেক বিতর্কের সূচনা হলো। মীমাংসিত অনেক বিষয় নিয়ে শুধু বিতর্ক নয়, মারামারি, কাটাকাটি, লাঠালাঠি চলছেই। ১৯৭৫ সালের পর স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতা ও সর্বাধিনায়ক বিতর্কের সূচনা হলো। এসব বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরবর্তী তিন বছরের কোনো আলোচনার বিষয়ই ছিল না। তবুও মানুষকে ধোঁকা দিতে এবং সাধারণ মানুষের সামান্য রুটি-রুজি সংস্থানে ব্যর্থতা ঢাকতে ও অন্যান্য মতলবে প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে এবং বিশেষার্থে বঙ্গবন্ধু ও তার অবদানকে খর্ব করার জন্য এসব প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে আমদানি করা হলো। 
জাতির পিতা বিতর্ক এমন মাত্রায় পৌঁছল যে, বঙ্গবন্ধুকে যারা জাতির পিতা মানবে, তারা নাস্তিক হয়ে যাবে ও জারজ হবে বলেও মন্তব্য করল অনেকেই। অথচ এদের অনেকেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পিতা বা বাবা ডাকতে ডাকতে মুখে ফেনা তুলত এবং সুযোগ পেলে এখনও ওই নামে ডাকতে উদগ্রীব। তাদের কেউ কেউ সশস্ত্র পন্থায় কিংবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে সেদিনও উদগ্রীব ছিল। ধারণা করছি, ১৯৭৫ সালের পর বিবিধ বিচিত্র পরিবর্তনগুলো সে পথে অগ্রসর হওয়া ও গন্তব্যে পৌঁছার আবহ তৈরি করেছিল। জাতির পিতা বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। মওলানা ভাসানীকে সে জায়গায় বসানোর প্রয়াস তীব্রতর হলো; পরে বোঝা গেল স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কে তীব্র হাওয়া লাগিয়ে জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতার আসনে বসানোর প্রয়াস ছিল। এর পাশাপাশি চলল সর্বাধিনায়ক বিতর্ক। 
স্বাধীনতার ঘোষণা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক বলা অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক এবং সত্যের অপলাপ। শত্রুপক্ষ পরিকল্পিতভাবে আর মিত্রপক্ষ অজ্ঞতার কারণে এখনও জেনারেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর একটি মতলব বা অজ্ঞতার ব্যাপার হচ্ছে শেখ মুজিবের অভিধা নিয়ে। 
এখন সারা জাতি তাকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাংলাদেশে এখনও অনেকে আছেন, যারা তাকে শেখ মুজিবুর রহমানই বলেন। হঠাৎ হঠাৎ বঙ্গবন্ধু শব্দটি হয়তো উচ্চারণ করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের আন্দোলন ও ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এখন চলমান আন্দোলনে জয় বাংলা বলা হলেও জয় বঙ্গবন্ধু বলা যাবে না কেন, তা বোধগম্য নয়। অথচ বঙ্গবন্ধু একটি মীমাংসিত সত্য। 
১৯৬৯ সালে মহান গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেয়া হয়। সে খেতাব তাকে আওয়ামী লীগ দেয়নি, দিয়েছে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আমরা সবাই কমবেশি গণতান্ত্রিক; কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শেখ মুজিবকে দেয়া বঙ্গবন্ধু অভিধাটি সজ্ঞানে পরিহার করে আমরা কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিচ্ছি? বঙ্গবন্ধুকে তার বাঙালিপ্রীতি ও বাঙালি স্বার্থে অনমনীয় অবস্থানের জন্য সে অভিধা দেয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ- আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নয়। তাকে দেয়া জাতির পিতা খেতাবটি ছাত্রদের দেয়া। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সারা জাতির পক্ষে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাকে সর্বাধিনায়ক উপাধি দেয়। দুইটি অভিধা পরবর্তীকালে সাংবিধানিকভাবে গৃহীত হয়। তারপর বিবিসির বিশ্বব্যাপী জরিপে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত হলেন। এ অভিধাও অনেকে মানতে নারাজ। আমার মনে আছে, এ অভিধা প্রাপ্তির পর সেটাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বিটিভিতে অনুষ্ঠান হয়েছে এবং ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নামই পরিবর্তন করে দেয়া হয়। যুুক্তি হিসেবে বলা হয়, ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির নাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম রাখার কারণেই সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে তার নাম ছড়িয়ে তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির অবস্থানে নিয়ে আসে। 
তারপরও আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা একই সভায় কিংবা আসরে তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলছে, আবার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কিংবা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালিও বলছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যতিক্রম। বিবিসির জরিপের পর বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু বলতে তাকে আমি অন্তত শুনিনি। ইতিহাস বিকৃতিতে আমাদের অবদান তারপরও থেকে যাচ্ছে। 
এ পর্যন্ত যেসব বিষয়ের অবতারণা করলাম, তাদের প্রায় সব ক’টিই মীমাংসিত সত্য; কিন্তু মনে হয় সেগুলো শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। এতসব নেতিবাচক বিতর্ক সত্ত্বেও আমরা আজ বিশ্বে একটি প্রাগ্রসর সম্মানিত জাতি। আমরা যদি এসব অহেতুক বিতর্কে সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে না জড়াতাম, তাহলে আমাদের সময়, সামর্থ্য, প্রণোদনা ও চেতনা সাধারণ মানুষের মঙ্গলে কাজে লাগাতে পারতাম। আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার জন্য যুদ্ধ করেছি। সোনার বাংলা শব্দের অর্থ সোনা দিয়ে মোড়া বাংলা নয়। তার অর্থ হচ্ছে কমপক্ষে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, রোগশোক ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি মানবিক দেশ। এ মানবিক দেশে সব মানুষ খাবার পাবে, শিক্ষা পাবে, চিকিৎসা পাবে, বাসস্থান পাবে, কেউ কারও বাড়িঘর শুধু ধর্মীয় কারণে পুড়িয়ে দেবে না। আমরা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে আমরা প্রথমে মানুষ, তারপর বাঙালি, তারপর হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এমন দেশের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি আর উত্তর যৌবনেও লড়ছি। 

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও উপাচার্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

SUMMARY

554-1.jpeg