পনেরো আগস্ট বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ দিন- জাতীয় শোক দিবস। বাংলাদেশ স্মরণ করছে তার স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের এ দিনে কতিপয় রাজনৈতিক কুচক্রীর যোগসাজসে সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকগোষ্ঠী হত্যা করে জাতির অবিসংবাদিত নেতাকে। শুরু হয় এক অ-সাংবিধানিক স্বৈরশাসনের কাল। একে একে ধ্বংস হয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাঙালির সব অর্জন।
১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ২টা। নিস্তব্ধ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। ভারী সব সামরিক যানের শব্দে ভেঙে পড়ে সেই নির্জনতা। বালুঘাটে আর্টিলারির ট্রেনিংফিল্ডে আসেন কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা। নৈশকালীন প্রশিক্ষণের অজুহাতে সেখানে জড়ো করা সৈন্যদের জানান পুরো পরিকল্পনা। ভোর পৌনে ৫টার দিকে ৩টি দলে ভাগ হয়ে ট্যাঙ্ক ও কামান বহর নিয়ে রওনা দেয় কিলিং মিশন। উদ্দেশ্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর।
ভোরের নিস্তব্ধ ভাঙা গুলির শব্দে ৩২ নম্বরের দোতলার ঘর থেকে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খুনিদের লক্ষ্য করে হুঙ্কার ছাড়েন। আর এর পরপরই ঘাতকের ব্রাশফায়ারে লুটিয়ে পড়েন জাতির জনক। একে একে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, দুই ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এমনকি সবার আদরের ছোট্ট শিশু রাসেলকেও হত্যা করে ঘাতকরা। ওই সময় দেশে না থাকায় কেবল প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
একই সময়ে খুনিচক্রের আরেকটি দল অপারেশন চালায় ধানমণ্ডি লেকের অপর পাড়ে বঙ্গবন্ধুর বোনের ছেলে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ মনিরের বাসায়। সেখানে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে শেখ মনি এমনকি তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকেও।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লক্ষ্য করে ছোড়া ঘাতকদের কামানের গোলা গিয়ে পড়েছিল মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের টিনশেড বস্তিতেও। গোলার আঘাতে ১৩ জন নিহত হলেও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা সেই মামলার বিচার আজও শেষ হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ঙ্কর সেই হত্যাকাণ্ডের হোতা ও ঘাতকদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করারই চেষ্টা হয়েছে। এমনকি পরবর্তীতে নানাভাবে খুনিরা পুরষ্কৃতও হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে জারি হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। তবে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে বাতিল হয় সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে বিচার শুরুও হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শাসনামলে রায় কার্যকরে বাধা সৃষ্টি করা হলেও বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে সম্পন্ন হয় বিচারকাজ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের রায় কার্যকর হয় ২০১০ সালে ২৭ জানুয়ারি। কিন্তু এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের উদ্যত সঙ্গীনের সামনে শোক আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ। সপরিবারে জাতির পিতাকে হারানোর সেই শোক অনির্বাণ, চিরবহমান। তেমনই বহমান বাংলাদেশের কোটি মানুষের বুকে তাঁর এনে দেয়া স্বাধীনতা।