ওয়ালিউর রাহমান
বঙ্গবন্ধু হত্যার সাত দিন আগে আমি অক্সফোর্ড থেকে ঢাকা ফিরলাম। ১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু কিছু কথা বলবেন বলে আমাকে খবর পাঠালেন। বঙ্গবন্ধুকে তার ইচ্ছানুযায়ী আমি সুইজারল্যান্ডের সংবিধান পড়ে শোনাচ্ছিলাম। ১৫ আগস্ট ভোর রাতে ইতিহাসের জঘণ্যতম হত্যাকা- ঘটল, বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম খুনের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর খুনের পর সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য বিভিন্নভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাল। যারা এই ষড়যন্ত্র করেছে তার মধ্যে প্রধান যার নাম উঠে আসে তিনি মে. জে. জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে লে. কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) আব্দুর রশীদ তাদের ইন্টারভিউ থেকে সব কিছু জানা যায়।
অত্যন্ত চতুর ব্যাক্তি ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি গভীর চিন্তা ভাবনা করে কাজ করতেন। খন্দকার মোস্তাক, জিয়াউর রহমান এবং মাহবুবুল আলম চাষী এরা সবাই মিলে চিন্তা করলেন, আলাপ-আলোচনা করলেন। জানা যায় লে. কর্নেল (অব.) আব্দুর রশীদ এবং ফারুক রহমান আরও অনেকেই ছিল এরা সাবাই মিলে আলোচনা করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এই জাতীয় চার নেতাকে যদি সরিয়ে না ফেলা হয় তাহলে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরতরে সরানো যাবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দেশ পরিচালনা করার স্বপ্ন দেখেন তাদের চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হবে। তারা এটাও জানত যে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে হবে না, এই চার নেতা যারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত করবে তাদেরকেও চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হবে। এরা থাকলে বাঙালির হৃদয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরতরে দুরীভূত করা যাবে না। এই জঘণ্যতম হত্যাকা-ে একটি বিদেশি শক্তির সহায়তাও ছিল।
খুনিরা এই চার নেতাকেÑ প্রয়াত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসানাত মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মুহাম্মদ মনসুর আলী খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ খুনিরা জানত এরা জীবিত থাকলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকেই তারা বাস্তবায়িত করবে। যারা খুনিদের নীরব এবং সরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল তারাও এটা পছন্দ করল না। তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর কিছু লোক বিশেষ করে মেজর ডালিম তখন বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বলা শুরু করল এবং বাংলাদেশ বেতারকে বাংলাদেশ রেডিও বলা শুরু করল। এখান থেকে বোঝা যায় সমস্ত কিছু পরিচালনা এবং চার নেতাকে হত্যা করা যারা মুজিব নগর সরকার চালিয়েছে তাদের খুন করাই ছিল খুনিদের প্রধান উদ্দেশ্য। খুনিরা জানত এদের খুন করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বলে কিছু থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের দেশ। যাদের মাধ্যমে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র পাওয়া গেছে তাদের না সরালে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। এজন্যই তারা এ ধরনের একটা ঘৃণিত হত্যাকা- চালিয়েছিল। তাদের চিন্তা ভাবনা ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কনফেডারেশন করা। যেটা ভুট্টো সাহেব চাচ্ছিল এবং তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তার চিন্তা ধারার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
খুনের আগে এবং পরের সময়টিতে অনেক কিছু ঘটেছে। যার সম্পূর্ণ ইতিহাস বোধহয় এ পর্যন্ত লেখা হয়নি বা অজানাই রয়ে গেছে। তবে এটা আমরা জানি যে বিগ্রেডিয়ার (পরে) জেনারেল মোশাররফ তিনি চেষ্টা করেছিলেন এই খুনীদের শাস্তি দিতে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। কিন্তু তার কিছু স্ট্র্যাটেজিক ভুলের কারণে তিনি তার জীবন দিলেন এবং পুনরায় সামরিক শাসনে দেশ পরিচালনা করার সুযোগটা দিয়ে দিলেন। তার মৃত্যুর পর আবার সেই অপশক্তি দেশ পরিচালনার কাজে লিপ্ত হলো। এই পর্যায়ের ইতিহাস লেখা হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ ইতিহাস লেখা হয়েছে কিনা এটা এখনো অনেকেই প্রশ্ন করেন। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল এবং দেশের চার জাতীয় নেতাকে খুন করেছিল তাদের মধ্যে প্রধান কিছু ব্যক্তিদের বিচার কার্যকর করা হয়েছে। আরও কিছু ব্যক্তি যারা এই দুটো খুনের সঙ্গে জড়িত আছে, যারা এখনো দেশের অবস্থান করছে। দেশবাসী চায় সরকার আবার ১৯৯৬-৯৭ সালের মতো একটি শক্তিশালী ট্রাস্ট ফোর্স গঠন করে যে সব খুনি এখনো দেশের বাইরে আছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে। এটা বাংলাদেশের জনগণের দাবি।
দেশে আইনের শাসন আছে, আইনের শাসন রয়েছে। আইনের শাসন চলবে এবং আরও সুসংহত হবে। যে খুনিরা দেশের বাইরে আছে এদের দেশে ফিরিয়ে আনা এবং শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা আছে, এটা চলবে এবং এই খুনিদের বিচারের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র আরও সুসংহত করতে হবে।
পরিচিতি : নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক