মো. আবদুল কুদ্দুস
বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার দাবি আদায়ে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, শহর-নগরে। তিন বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশোরে কয়েক শত ছাত্র গ্রেফতার হয়েছিল। রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর ও আরও অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছে। বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচ ভাষায় কথা বলে।
উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হয় আমরা বুঝতে পারলাম না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানেরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফারসি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালোশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীন ভাষায় কথা বলে। এ সমন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে।
শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, “উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”Ñ তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না’। জিন্নাহ পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করলো বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে […] (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.৯৮-৯৯)।’
ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কথা হয়। গুণী এই শিল্পী বঙ্গবন্ধুকে বলেন-‘ মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।” আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.১১১)।
২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়েরিতে লিখেন, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি যা সম্প্রতি তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ১৫ বছর পর তিনি এই ডায়েরি লিখেন-“আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান। ১) আবদুস সালাম, ২) আবদুল জব্বার, ৩) আবুল বরকত, ৪) রফিক উদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই।
ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এই দিন আমিও রাজবন্দী ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে স্থির হয়। আমাকে আবার হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুরে জেলে চালান দেওয়া হলো।
১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইনসভার সামনে লাঠি চার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘ নাজিমুদ্দিন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে।’ ২১ মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন।
সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়া বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। ছাত্ররা তাঁর সামনেই প্রতিবাদ করল […]। …তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল। এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারীভাবেও পালন করা হয়েছে […] (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.২০৫-২০৭)।
লেখক: শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী