বঙ্গবন্ধু এবং ভাষা আন্দোলন

মো. আবদুল কুদ্দুস 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় লিখে যাওয়া দুটি আকর গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যে সংগ্রাম করেছেন সেই ইতিহাস তিনি সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। আমি এই প্রবন্ধে জাতির পিতার এই অসীম অবদান সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:-“ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচিতে সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বিলী) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল।

মুসলীম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলীম লীগ সদস্যের সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষঢ়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
 
আমরা সভা করে প্রতিবাদ করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সভা আহব্বান করে একটা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তমুদ্দুন মজলিস একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। এদিকে পুরানা লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করলেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে যেসমস্ত কৌশল নিয়েছিলেন তা তুলে ধরেন এভাবে; সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো।

জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম […]। ১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল […]। এরপর ঘটে গেলো আরো অনেক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু অন্যদের সাথে গ্রেফতার হন। এরপর তিনি লিখেছেন:-‘ …আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভিতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত।

ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরণের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।” হক সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ মুজিব।” আমাকে ১১ তারিখ জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয় […] অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.৯১-৯৬)।
বঙ্গবন্ধু একজন আশাবাদী নেতা। ব্যর্থতা বা সময়ক্ষেপণ তাঁকে কোন আন্দোলন থেকে দূরে সরাতে পারে নি। ভাষার দাবি আদায়ে তিনি যে সারাক্ষণ কাজ করছেন তা তিনি তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন এভাবে। …১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য।

সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সাভাপতিত্ব করতে হল। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপোস হয়েছে তার সবগুলিই সভায় অনুমোদন করা হল। তবে সভায় খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; কারণ খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, “যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত।

শুধু আমরা ঐ সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি, এর বেশি কিছু না।” ছাত্ররা দাবি করল, শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদে গিয়ে খাজা সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায় বললাম, তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েই আপনারা আইনসভার এরিয়া ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবে না। কারণ সংগ্রাাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছু দিনের জন্য। সকলেই রাজি হলেন […] (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.৯৭)।
লেখক: শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী

SUMMARY

526-1.jpg