ওয়ালিউর রহমান
স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্য দৃশ্যমান। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা, জনগণকে কাছের টানা শক্তি, আকষর্ণীয় ব্যক্তিত্ব, আপোসহীন মানসিকতা মানুষের মন জয়ে সাহায্য করেছে। বলা যায়, মানুষকে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন অসম্ভব প্রাণের টানে, ভালোবেসে। কাজ দিয়ে। রাজনীতিতে তিনি সফল একজন মানুষ। তবে তার কূটনৈতিক সাফল্যও ঈর্ষণীয়।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে মেধা-মনন দিয়ে রাজনীতি করেছেন। আওয়ামী লীগকে ‘আওয়ামী মুসলিম থেকে আওয়ামী লীগে’ উত্তরণ করে জাতীয় পর্যায়ের একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটা ছিল তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কূটনৈতিক সাফল্য। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা সম্ভব সবভাবে চেষ্টা করেছে তাকে দাবিয়ে রাখতে। বিভ্রান্ত করতে। একইসঙ্গে তার সঙ্গি-সাথীদেরও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি একভাবে, এক চিন্তায় সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে তিনি শুধু রাজনৈতি আলাপই করেননি, একটা কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনাও করতেন। এসব বিষয়ে আমাকে বহুবার তিনি বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু যাকে রাজনৈতিক গুরু মানতেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তার কথাও আমাকে তিনি বলতেন। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, ‘হ্যাঁ-রে, আমার রাজনৈতিক গুরু তো অনেকেই আছেন। তবে হোসেন শহীদ সোহরাওর্দীই আমার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরু’। তারপর তিনি দুঃখ করে বললেন, ‘দেখ, আমি তো কিছুই করতে পারলাম না সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জন্য, তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল আইয়ুব খান। তিনি লেবাননের বৈরুতে গেলেন। কিন্তু আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম যে, আপনার থাকার ব্যবস্থা আমরা করব। আপনি লন্ডনে যান, সেখানে তিনি গেলেন না, গেলেন বৈরুতে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার আর বলার কিছু ছিল না। ওখানেই তিনি মারা গেলেন অজ্ঞাত কারণে’। বঙ্গবন্ধু আমাকে আরও বললেন, ‘বিভিন্ন কূটনৈতিক সোর্সের মাধ্যমে তার মৃত্যু সম্পর্কে আরও কিছু জানতে আমি চেষ্টা করে যতদূর জেনেছিলাম, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পায়নি’। তার সঙ্গে আমার এ কথোপকথন হয় জেনেভায়, ১৯৭২ সালের আগস্ট- সেপ্টেম্বরে।
বঙ্গবন্ধু যখন দেশ শাসনের সুযোগ পেলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বৈরুত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। এবং যে হোটেলে সোহরাওয়ার্দী মারা যান, সেখানে তার বাক্স, কাপড়-চোপড়সহ সবকিছু ওখান থেকে নিয়ে আসলেন। ১৯৭২ সালের আগস্টের শেষের দিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) আতহার বৈরুত থেকে বাক্সটি এনে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এখানেও তিনি বড় ধরনের কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক সাফল্যও ব্যাপক। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ১৩৫টি দেশের সমর্থন আদায় করলাম, স্বীকৃতি পেলাম। এটা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া সম্ভব হতো না। পৃথিবীর অনেক দেশ তখন বাংলাদেশকে ভালোভাবে চিনত না, ভারতের পাশের একটি দেশ এটা জানত। কিন্তু শেখ মুজিবকে তারা চিনত। বিশ্বব্যাপী তার যে পরিচিতি ছিল, এতে আমাদের কাজ করতে অনেক সহজ হয়েছিল। আমি তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরেছি, স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করেছি, কথা বলেছিÑ সবকিছুই করতাম বঙ্গবন্ধুর নাম করে। বঙ্গবন্ধুর সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় স্বাধীনতার স্বল্প সময়ে ভারতের সেনারা এদেশ ছেড়েছিল। রাজনীতিক শেখ মুজিব কূটনীতিতেও সবার সেরা ছিলেন।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত