১৯৬২ সালেই বঙ্গবন্ধুর মাঝে ‘স্বাধীন বাংলা’র ধারণাটি বিমূর্ত ছিল!


মোহাম্মদ আলী বোখারী 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল, তেমনি ‘স্বাধীন বাংলা’র ধারণাটি যে ১৯৬২ সালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে বিমূর্ত ছিল, তার একটি চমকিত প্রমাণ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সাতচল্লিশ বছর পরে হলেও উন্মোচিত হয়েছে। গত ১৬ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় মুদ্রিত ‘ছাত্রনেতাদের মুক্তিযুদ্ধ’ কলামে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, একাত্তরে মুজিব বাহিনী নোয়াখালী জেলা প্রধান এবং সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুর রহমান বেলায়েত তার লেখনী ‘যুদ্ধপ্রস্তুতি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন জিয়া’ শিরোনামে তা তুলে ধরেছেন।
সেখানে তিনি সূচনায় লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সাল। নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজে পড়ি। ছাত্রলীগের রাজনীতি করি। এ কলেজে ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচন করে এজিএস, জিএস ও ভিপি হই। সিরাজুল আলম খান নোয়াখালী এলেন। ছিলেন প্রায় এক সপ্তাহেরও বেশি। প্রতিদিনই আমার সঙ্গে দেখা হতো। আমাকে একা নিয়ে রাজনীতির আলোচনা করতেন। মনে পড়ে, সাত দিন ধরে তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলার কথা। বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন করতে হবে, প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রাম করে হলেও। জানতে চাইলাম, আপনার এই স্বাধীন বাংলার পেছনে কে কে আছেন? সিরাজুল আলম খান অকপটে বললেন, মুজিব ভাই (শেখ মুজিবুর রহমান) ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। এ দুজন, বিশেষ করে মুজিব ভাইয়ের কথা শুনে বললাম, তা হলে আপনার স্বাধীন বাংলার সঙ্গে আছি। কথায় কথায় সিরাজুল আলম খান আরো বললেন, ১৯৬২ সালেই মুজিব ভাই ও মানিক মিয়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন, সেভাবে প্রস্তুতিও শুরু করেছেন। তিনি আরো বললেন, আমি এ ধারণা প্রচারের বাহকমাত্র। মুজিব ভাইয়ের নির্দেশেই স্বাধীন বাংলার কথা প্রচার করছি’।

তিনি আরও লিখেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে। এর আগে দেখা হলেও একান্তে কথা হয়নি। নোয়াখালীর একজন আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, ঢাকায় একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে। তারপর থেকে অনেকবার দেখা, অনেকবার একান্তে কথা হয়। আমিও নোয়াখালী ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। একদিন মুজিব ভাইকে আমি স্বাধীন বাংলার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ঠিক আছে। সিরাজুল আলম খান আমাকে স্বাধীন বাংলার কথা বলেছেন, সেটাও মুজিব ভাইকে জানালাম; তিনি বললেন, আমার জানা আছে’।
 
তবে ওই লেখায় মাহমুদুর রহমান বেলায়েত তাৎপর্যপূর্ণভাবে লিখেছেন, “রাজধানীর রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনি। ৭ই মার্চের আগে নানা কথা ছিল বাজারে। অনেক ছাত্রনেতার দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু যেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চাপও ছিল। সিরাজুল আলম খানরা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। গোটা রেসকোর্স যেন সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের মতো গর্জে উঠল। আমরা বলাবলি শুরু করলাম বঙ্গবন্ধু তো স্বাধীনতা ঘোষণাই করে দিলেন। ৮ মার্চ দুপুরের খাওয়ার সময় আমি ৩২ নম্বরে যাই। দেখি নেতা (বঙ্গবন্ধু) পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। অপেক্ষা করি। নেতা বাইরে এলেন। দেখেই বললেন, তোমাদের স্বাধীনতার তো ঘোষণা দিয়ে দিলাম। আমি শুধু বললাম, এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে এলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, যাও প্রস্তুতি নাও”।

আর সেই প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, ‘মার্চের প্রথম থেকেই আমরা একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে এনে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। প্রশিক্ষণ হতো বুয়েটে। সেই সময় হাসানুল হক ইনু (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। আমি নোয়াখালীতে ছিলাম। সেখানে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। ওই সময় কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি পড়েছিলেন, আমি সেটা শুনেছি। অনেকটা দৈবক্রমে ৫ বা ৬ এপ্রিল নোয়াখালীর মাইজদীতে দেখা মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। একটি জিপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। খবর পেয়ে গেলাম জিয়াউর রহমানের কাছে। মনে করলাম তাঁর কাছে হয়তো সর্বশেষ খবর ও কিছু নির্দেশনা পেতে পারি।

কারণ তিনি বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়েছেন। পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ছাত্র-তরুণরা তো যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত, কোনো ব্যবস্থা কি আপনার জানা আছে? কোথায় গেলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে? জিয়াউর রহমান কিছুই না বলে, কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত জিপ নিয়ে চলে গেলেন। পরে আগরতলায় গিয়ে মেজর সফিউল্লাহ, এ টি এম হায়দার ও জাফর ইমামের সঙ্গে দেখা হলে তাঁদের কাছে জিয়াউর রহমানের বিষয়টি বললাম। তিনজনই বললেন, এটা তো করার কথা নয়, জিয়া তো জানেন সবাইকে ভারতে আসতে হবে। তিনি নিজেও তো চলে এসেছেন। বিষয়টিতে খটকা লাগল। এর মধ্যে খবর পেলাম প্রশিক্ষণ নিতে আগরতলা যেতে হবে। নোয়াখালী-কুমিল্লাসহ পূর্বাঞ্চলের লোকদের যেতে হবে আগরতলা। এপ্রিলের শেষ দিকে আগরতলা পৌঁছাই। ততদিনে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়ে গেছে।

আগরতলায় উঠলাম শ্রীধর ভিলায়। সেখানে দেখা ফজলুল হক মণি, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনের সঙ্গে। মনি ভাই ক্যাম্পে রিক্রুটিংয়ের দায়িত্ব নিতে বললেন, তাঁকে জানিয়ে দিলাম আমি এসেছি প্রশিক্ষণ নিতে, দেশে ফিরে যুদ্ধ করব। মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিতে গেলাম দেরাদুনের টান্ডুয়া ক্যাম্পে। আগরতলা থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সিট ছাড়া বিমানে নামলাম শাহরানপুর এয়ার বেসে। সেখান থেকে টান্ডুয়া ক্যাম্পে। আমাদের ক্যাম্প দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন নূরে আলম জিকু। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ক্যাম্পে এসে বক্তব্য দিতেন। প্রশিক্ষণ সময়ের একটি ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে, ভারতীয় জেনারেল সুজন সিং উবান আমাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এসে কেঁদে ফেললেন, তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে দেখলাম। কাঁদলাম আমরাও। প্রশিক্ষণ শেষে জুলাই মাসে আগরতলা হয়ে দেশে ফিরি। আমাকে নোয়াখালী জেলা (বর্তমান বৃহত্তর জেলা) মুজিব বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়’।

SUMMARY

513-1.jpg