বঙ্গবন্ধু স্নেহের আদরে আমাকে জড়িয়ে নিলেন


রবিউল আলম  
১৯৭৩, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, বাংলাদেশ। অনেকের মতো আমিও তখন বেকার, কাজের কোথাও কোনো ব্যবস্থা নেই। জীবন একরকম থেকে আছে। কিছু না কিছু তো করতে হবে। বাঁচতে হবে। জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় চিনাবাদামওয়ালা হয়ে, ৩২ নম্বর ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বাদাম বিক্রি করি। ৩২ নম্বর বাড়িতে সেই সময় প্রতিদিন হাজারও মানুষের সমাগম হতো। স্বাধীন বাংলাদেশের নানাবিধ সমস্যা। সমস্যার সমাধান চাই। কে দিবে ? কার কাছে যাবে মানুষ? একজন অন্তত আছেন তাদের, তিনি আর কেউ নন, আপামর জনসাধারণের আদরের মুজিব। ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক সেই বাড়িতে, বাড়ির সামনে হাজারও মানুষ হাজির হতো সমস্যা, সংকটের সমাধানের আশায়। তার সঙ্গে একটুখানি সাক্ষাতের আশায়।

ওই সময় অনেক হকার ছিল, যারা বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করত। আমিও বিক্রি করতাম বাদাম। প্রচুর বাদাম বিক্রি হতো। প্রতিদিন প্রায় নিয়ম করেই ৩২ নম্বরে হাজির হতাম ভালো বেচাকেনার আশায়। বেচাকেনা ভালো তো, সংসারেও গতি ফিরে। স্বচ্ছলতা আসে। ছয় ভাই, দুই বোন, বাবা, মা, দাদা-দাদী নিয়ে ১২ জনের সংসার দু’বেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। ভাগ্য সহায়ক হয় রেশন কার্ড থাকায়, বারো আনায় চাল, সাড়ে আট আনায় গম, আট আনায় লবন, কেরোসিন, সাবান, চিনি নিত্যপন্য সামগ্রী রেশনে পাওয়ায় কোনোরকমে সংসার চলে যেত। একদিন চিনাবাদাম নিয়ে ৩২ নম্বরের লেকের পাড় বসে আছি, বেচাকেনাও ভালো তাই খুব ব্যস্ত। ঠিক ওইরকম একটা সময় পুলিশ এসে আমার বাদামের টুকরিটা লাথি মেরে ফেলে দিল, সজোরে হাতের লাঠি দিয়ে আমার পিঠে আঘাত করল। বলল, তোকে না কতবার মানা করেছি, এখানে বাদাম বিক্রি করবি না।
 
লাঠির আঘাতে আহত আমি, কিছুই বলতে পারছি না, ভয়ে অস্থির। আঘাতের চেয়েও বড় ভয় – বাদাম বেঁচতে না পারলে সংসারের কি হবে ? কিভাবে এতগুলো মানুষের আহার জোগাড় হবে? নানা দুশ্চিন্তায় অস্থির, অন্যমনস্ক হয়ে আছি। হঠাৎ ভারী কন্ঠ শুনলাম। বলছেন, ‘এই, তুই অই বাদামওয়ালার বাদাম ফেললি কেন? আমি পিঠের হাত সরিয়ে একটু সোজা হয়ে বসি, পুলিশ বলল, স্যার, এই বেটাকে প্রতিদিনই বলি তোর বাদামের খোসায় এলাকা ময়লা হয়, আমার কথা বেটা শুনে না। পুলিশের কথা থামিয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘আমার বাড়িতে তো প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে, ময়লা তো হইবই’। পুলিশ বলল, স্যার ভুল হইয়া গেছে, মাফ কইরা দ্যান। কাকে স্যার বলছে পুলিশ ? তাকিয়ে দেখি শেখ সাব। আমাদের মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু।

আমি দেখছি। দেখেছে উপস্থিত বহু মানুষ। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অপরাধ তোর, শাস্তি তোর বউ-পোলাপান পাইব ক্যান? বাদামওয়ালাকে নিয়ে আয়’। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছি। সাদা লুঙ্গি, সাদা গেঞ্জি, হাতে পাইপ, রাগান্বিত ভঙ্গিমায় পাইপে টান দিয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিদিন বাইরে থেকে বঙ্গবন্ধু লেকের দিকেই তাকিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেন। কারণ, অনেক মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতেন। সেদিনও বঙ্গবন্ধু লেকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমার বাদাম ফেলে দেওয়ার দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্গবন্ধু। পুলিশ এসে বাদাম তুলছেন, অনুনয় করছেন তাড়াতাড়ি চল – প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে, আমাকে কি কোনো সাজা দেবেন প্রধানমন্ত্রী ? আমি পুলিশের হাতে পায়ে ধরছি। ভাই, আমাকে বাঁচান, আমি আর এখানে বাদাম বেচমুনা আর কখনও এখানে আসমু না, আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়েন না। যতপ্রকার আকুতি আছে, আবেদন করছি কিন্তু কে শোনে কার কথা ? পুলিশ আমাকে জোর করে নিয়ে গেল, বঙ্গবন্ধুর সামনে, ৩২ নম্বর বাড়ির ভিতরে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও অনেকেই বসে আছেন, নামগুলো মনে নেই। বঙ্গবন্ধু দুই-তিনটা বাদাম খেয়ে বলছেন, ‘তোর বাদামগুলো অনেক মজারে, তোর ভাই-বোন কয়জন, সংসারে আর কে আছেন, বাবা কি করে? কত প্রশ্ন আমাকে, যিনি করছেন তিনি বঙ্গবন্ধু। তার সামনে আমি, আমাকেই এতসব জিজ্ঞেস করছেন।

আমি শুধু বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে আছি, কি শাস্তি তিনি দিবেন, কি হবে আমার, কেমন করে চলবে আমাদের সংসার। বঙ্গবন্ধু কন্ঠ ভারী করে বললেন, ‘এদিকে আয়’। আমি ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভয় নেই চিন্তা করিস না। তোকে বাদাম বেঁচতে আর কেউ মানা করব না। এই নে, ধর – একশত টাকা, তোর বকশিস’। টাকা দিয়ে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি অঝরে কেঁদে চলেছি, আর বলছি, টাকা লাগব না, স্যার, আমারে মাফ কইরা দ্যান’। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, কেন টাকা নিবি না, আমি প্রধানমন্ত্রী বলে ? কিছু বলতে চাইছিলাম না। তবুও নিজের অজান্তে বলে বসলাম, আপনি বাঙ্গালি জাতির বন্ধু। আপনারে সবাই সম্মান করে। আমি খুব সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধু ¯েœহের আদরে আমাকে জড়িয়ে নিলেন। তার বুক যেন তুলার বস্তার মতো তুলতুলে, আজও স্মৃতিতে অমলিন।

SUMMARY

492-1.jpg