ড. মোহাম্মদ হাসান খান
একটি দুঃসহ ভোরের কথা বলছি। একটি দুঃসহ সুবেহ সাদিকের গল্প বলছি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ফজরের আজান হচ্ছে। আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম। একজন মুসলমান আজান শুনে নামাজ পড়তে যাবে। অথচ সেদিনের সেনা ঘাতকেরা গেল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল। দশ বছরের রাসেল ও চার বছরের সুকান্ত বাবুও বাদ গেল না। এরা কেমন মুসলমান যারা মানুষ হত্যা করে? ওইদিন শুধু একজন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা, সংস্কৃতি ও সংবিধানকে। দেশ স্বাধীন হয়ে ১০০ বছর এগিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে পেছাল আরও ১০০ বছর। শুরু হল ধর্মের সাথে আমাদের সংস্কৃতি ও সংবিধানের সংঘাত ঘটানোর রাজনীতি। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তুলে সস্তা জনপ্রিয়তা নেয়ার জন্য সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ঢুকানো হল। আর অপরদিকে ইনড্যামনিটি এ্যাক্ট জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। এ কেমন ইসলামী রাষ্ট্রযন্ত্র তারা তৈরি করল যেখানে হত্যার বিচার চাওয়া যায় না। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থামেনি জাতীয় ৪ নেতাকেও হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানাকে দেশে আসতে দেয়া হয়নি। শুরু হয় বিদেশে তাদের রিফিউজি জীবন। ভারত তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। ১৯৮১ সালে তদান্তাধীন প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়া ভারতের চাপের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে দিলেও ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেয়নি। ৩২ নম্বরের রাস্তায় বসে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিলাদ দেন।
পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশকে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী হতে হয়। ক্ষমতার পালাবদলে এদেশে পাকিস্তানী দোসররাও সরকার গঠনে সুযোগ পায়। রাজকারদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চলে ইতিহাস বিকৃতির উৎসব। কিন্তু অপচেষ্টাকারীরা জানে না, ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের কোন মৃত্যু নেই। আদর্শই ব্যক্তিকে জীবিত রাখে যুগ যুগ ধরে। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেন তিনি ইচ্ছা করলে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিচার করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি, ঘাতকদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দেয়া হয়, গণহারে মুক্তিযুদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়। রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। জেল থেকে মুক্তি দেন নিজামিকে, এসব কিছুই প্রমাণ করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যে শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার ও চার নেতা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে একটি কমিটি করা হয়। এ কমিটি বাংলাদেশে আসতে চাইলেও জিয়া সরকার তাদের ভিসা দেয়নি। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ হাসিনাকে দমিয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী কম চেষ্টা করেনি। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার চেষ্টা করে তারা আবার চেয়ে ছিল এই বাংলাদেশ যেন আলো না দেখে, বাংলার পূর্ব আকাশে যেন আর সূর্য না উঠে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বাঙালি জাতির আরেক আলোকবর্তিকা। যিনি আজ এদেশ তথা বাঙালিকে নিয়ে গেছেন মহাকাশে ও বিশ্বের বুকে এক নক্ষত্র হিসাবে। ১৯৯৬ সালে পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর শেখ হাসিনার রাজপথে থেকেছেন। এ বছরই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার জনগণকে ঘুরে দাঁড়াতে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নিপীড়িত হয়েছেন, জেল জুলুম সয়েছেন, মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন কিন্তু পথহারা হননি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়াল। স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত হল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু হলো। বর্তমানে টানা দু মেয়াদে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনা করছেন। তাঁকেও নিচিহ্ন করে দেওয়ার জন্য দেশীবিদেশী শত্রুরা বহুবার চেষ্টা করেছে। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার জন্য ১৯ বার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এতে মোটেও ভীত নন। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ ও লালন করে বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ফলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। তিনি এদেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। তার বিনিময়ে স্বাধীন দেশে কেউ তাঁর রক্ত ঝরাবে, এটি ছিল তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় বিষয়। যার কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও অবাধে সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছেন, সর্বত্র যাতায়াত করেছেন নির্দ্বিধায়। তাঁর পরিবারের মানুষজনও রাষ্ট্রীয় প্রটৌকল নিতে চাইতেন না। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামালসহ পরিবারের কেউই চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। শিশু শেখ রাসেল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনের সড়কে একা একা সাইকেল চালাতো। বরেণ্য সাংবাদিক এ বি এম মুসা স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শেখ রাসেল স্কুলে যাওয়ার সময়েও তার সাথে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী থাকত না। কেবল শিশু রাসেল নয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাই এভাবে চলাফেরা করতেন। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি বঙ্গভবনে থাকেননি। অনেক শুভাকাক্সিক্ষ তাঁকে নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনে যেতে বললেও তিনি যাননি। তিনি মনে করতেন, বঙ্গভবনে থাকলে তাঁর সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হবে। স্বভাবতই তিনি জনগণ থেকে দূর থাকতে চাননি। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান। তাঁর লেখা ‘ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগং’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ্য করলাম, তাঁর বাসায় কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইতো। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, “আমি জাতির জনক, দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।” বঙ্গবন্ধুর এমন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিয়েছিল পঁচাত্তরের ঘাতকরা। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি। জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর এন কাও ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে সানডের সংখ্যায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দিই। কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’ শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের মার্চে তাঁর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকা পাঠান। শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সাজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। এবারও বঙ্গবন্ধু এ সতর্কবার্তায় কান দেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, যাদের জন্য তিনি প্রাণ বাজি রেখেছিলেন, যাদেরকে তিনি সন্তান হিসেবে জানেন তারা তাঁকে কেন হত্যা করবে!