বাহালুল মজনুন চুন্নূ
বঙ্গবন্ধু মানুষে মানুষে ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকেই শোষণমুক্ত সমাজের কথা বলেছেন। আমাদের সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের কর্তব্য এবং নাগরিকের অধিকার নিয়ে যা বলা হয়েছে সেগুলো শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের মানস থেকেই প্রণীত। কেবল সংবিধানেই শোষণমুক্ত সমাজ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেই তিনি থেমে যাননি, নিতে থাকেন একের পর এক উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যাপক অগ্রগতি সাধনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রবর্তক। তার অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল নিজস্ব সম্পদের ওপর দেশকে দাঁড় করানো। তিনি সকল ব্যাংক-বীমা এবং পাট ও বস্ত্র শিল্প জাতীয়করণ করেন। পাকিস্তানের মতো অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ রুদ্ধ করার জন্য পুঁজির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জমির সিলিং একশ বিঘায় সীমিত করেন এবং পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেন। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু যে বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সৃষ্টি করেছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল দেশকে দ্রুত শিল্পায়ন এবং গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা।
কিন্তু একদিকে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিগুলো, অন্যদিকে চীনের অনুসারী উগ্র বামপন্থি, ভাসানীর ন্যাপ এবং জাসদ ইত্যাদি দলের নেতাকর্মীরা কল-কারখানায় অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা-খুন-সন্ত্রাস, থানা-ফাঁড়ি লুট ইত্যাদির মাধ্যমে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে। ওই সময়টায় বিশ্বব্যাংকের দুই কর্মকর্তা জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জে আর পারকিনসন বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের যদি উন্নয়ন সম্ভব হয়, তা হলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবিতাবস্থাতেই ফাল্যান্ড, পারকিনসনদের কথা মিথ্য প্রমাণিত হয়। প্রচ- প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কথা, কৃষকের কথা, মেহনতি মানুষের কথা চিন্তা করে দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক। এই বিপ্লবের মধ্যেদিয়ে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে, দেশ শোষণ-বৈষম্যহীন এক দেশে পরিণত হবে বলে তিনি আশা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন এই বিপ্লবের মধ্যেদিয়ে সমাজ থেকে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, অবিচার দূরীভূত হবে। প্রতিটি মানুষ তার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থায় দেশকে দ্রুত কাঙ্খিত উন্নতির পথে এগিয়ে নেওয়া এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ¬বের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। সমাজের কল্যাণকামী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক প¬াটফরমে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় পুনর্গঠনের মহাকর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন। সর্বস্তরের জনসাধারণ, বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সবাই যেন জাতি গঠনের কাজে অভিন্ন রাজনৈতিক প¬্যাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং সকলের মেধা-শ্রম যেন জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগে, সে জন্যই এই নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এই বিপ্লব নব্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের বিপ্লব, বিশেষ করে অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেই বিপ¬ব ছিল এক অনন্য পদক্ষেপ। তিনি যে শাসনতন্ত্র চালু করেছিলেন তা ছিল ক্ষমতালোভী চক্রের ক্ষমতা হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু সাম্য ও স্বাধীনতার আলোকে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য তিনি পাঁচসনা ভূমি ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভ সিস্টেম চালুমর মাধ্যেমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে চেয়েছেন। দুর্নীতির হাত থেকে দেশ বাঁচানো, উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি বলেছিলেন, আসুন নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি তথা কৃষক, শ্রমিক মেহনতি জনতার ভাত, কাপড়, কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মধ্যে দিয়ে এক সুখী সমৃদ্ধশালী আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে’। বঙ্গবন্ধু সেই অসাধ্য সাধনই করতে চেয়েছিলেন। এই বিপ্লবের ক্ষেত্রে অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হলো কো-অপারেটিভ সিস্টেম। এই সিস্টেমে বলা হয়, ছয় হাজার লোক নিয়ে গঠিত হবে আর্দশিক গ্রাম যেখানে বহুমুখী সমাবায় থাকবে। এর সদস্য হলো সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভূস্বামী ও ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গ্রাম সমবায়ের অধীনস্থ সমস্ত জমি কৃষিকর্তার নির্দেশে পরিচালিত হবে। জমিওয়ালা জমি দেবে, সরকার থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ, বীজ, সার সহ যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করা হবে আর ভূমিহীন জনগোষ্ঠী জমিতে শ্রম দেবে। উৎপাদিত ফসল তিনভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেন্নয়নের চেষ্টা করেছেন তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির মাধ্যেমে। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সেই বিপ্লবকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। বাঙালিকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তারা কেবল নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই বঙ্গববন্ধুর এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের ভুল ব্যাখ্যা করে দেশের অগ্রগতিকে রোধ করে দিতে চেয়েছিল। অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে বিপথে চলেও গিয়েছিল, এটা বাঙালি জাতির জন্য ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের এক বিষয়। তা না হলে আরও অনেক আগেই শোষণহীন সমাজ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াত বাংলাদেশ।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ