মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু


প্রফেসর ড. এম. শাহ্ নওয়াজ আলি 
আগস্ট এলেই মনে পড়ে শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধুুর কথা, বেগম মুজিবের কথা, শিশু রাসেলের কথা, ১৫ আগস্ট কালো রাতে শহীদদের কথা। আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। প্রতি বছর আগস্ট মাস আমাদের মাঝে ফিরে আসে শোকের আবহ নিয়ে। পক্ষান্তরে আগস্ট ফিরে আসে বঙ্গবন্ধুর কুখ্যাত ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনা আর শোককে শক্তিতে পরিণত করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত শপথ নিয়ে। ইতিহাস মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি শব্দ একে অপরের পরিপর ক। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিত্ব কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু নামটি একটি ইতিহাস। ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল মাত্র ৫৫ বছরের পার্থিব জীবনের সমগ্র সময়ই একটি মাহকাব্যের ইতিহাস। যদিও মহাকালের কাছে অর্ধশতাব্দী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র। তারপরও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব গায়ে অববাহিকার পলল সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ সৃষ্টির মহাকাব্যের যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন তা অনন্তকাল ধরে বহতা নদীর স্রোতের মতো বহমান থাকবে।

শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিবের প্রতিবাদ, নেতৃত্ব ও দেশ প্রেমের প্রবল বিকাশ ঘটেছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা, খেলাধুলা, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্যের সমস্যা ও বিপদে সবার আগে মানবিক দাবি নিয়ে এগিয়ে গেছন। শিশুকাল পেরিয়ে কিশোর বয়সের শুরুতেই শেখ মুজিব সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন প্রতিবাদের মাধ্যমে দাবি আদায়ের নতুন ‘ইতিহাস’। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোওরার্দী আসেন মহকুমা শহর গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পরিদর্শন শেষে তারা ডাক বাংলো ফিরছিলেন। শেখ মুজিব ওই স্কুলের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এমন সময় মুজিবের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। প্রধান শিক্ষকসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের পথ ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি চাও? শেখ মুজিব উত্তর দিলেন আমাদের স্কুলের হোস্টেলের টিনের চালা ভাঙ্গা, বৃষ্টির সময় পানি পড়ে, মেরামত করে দিতে হবে।
 
এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে শেরে বাংলা স্কুল হোস্টেল মেরামতের জন্য ১২০০ টাকা বরাদ্দ করেন। কিশোর ছাত্রের প্রতিবাদী মানসিকতা, সৎ সাহস ও স্পষ্টবাদিতা দেখে মুগ্ধ হলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। পাশে দন্ডায়মান গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে ফেললেন এ ছেলেটি ভবিষ্যতে অনেক বড় রাজনীতিবিদ হবে। স্কুল জীবনে প্রতিবাদী নেতৃত্বের কারণে ১৯৩৯ সাল থেকেই শেখ মুজিবের কারাভোগ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে মিশন স্কুল মাঠে ছাত্রদের জনসভা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ সৃষ্টি হয়। স্কুল মাঠ ছেড়ে মসজিদের সামনে জনসভা করেন। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ৮ম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবের কারা ভোগ শুরু হয়। ১৯৪২ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্রাবস্থাায় দৈনিক আজাদ পত্রিকা বন্ধের প্রতিবাদে তিনি ছাত্রদের নিয়ে মিছিল সমাবেশ করেছেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতাস্থ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন দাবি দাওয়া অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৬ সালে সরকার বিরোধী আন্দেলনে ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের অদে র সালাম নামে একজন কর্মীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনাটি শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা নেতৃত্ব ও দেশ প্রেমের মন্ত্রে নতুনভাবে আলোড়িত করে। ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলমান সাম্পধদায়িক দাঙ্গায় শেখ মুজিব ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিহারে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬ সালে মার্চে প্রাদেশিক নির্বাচনে উদিয়মান যুবক শেখ মুজিবকে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার নির্বাচন পরিচালনার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও সাংগঠনিক সফরের মাধ্যম নিরুষ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কারণে হোসেন শহীদ সোহরাওর্দীর একান্ত আস্থাভাজনে পরিণত হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাক-ভারত বিভক্তির পর পর্ব বাংলার মুসলিমলীগ রাজনীতিতে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়। এক গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী অন্য গ্রুপে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট খাজা নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের মুল উদ্যোক্ততা ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব।

সময়ের বিবর্তনে এল ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। জন্ম নিল পর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৮-৫৩ পর্যন্ত শেখ মুজিব পবর্ বাংলার প্রতিটি জেলা-মহকুমা সফর করে কমিটি গঠন করে ছাত্রলীগকে নতুন ধারায় সংগঠিত করে অনন্য স্থান দেন। বলা যায় ৪৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নার রাষ্ট্রধ ভাষা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের মধ্যদিয়ে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে দেশ প্রেমের নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব সেই আবেগ ও প্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটিয়ে পর্ব বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। এরপর ৫৪’ সাল থেকে থেকে ৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১৮ বছরের জেল, জুলুম, নির্যাতন হুলিয়াকে আলিঙ্গন করে সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে এগিয়ে গেছেন সামনে। ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ৫৮’র আয়ুব খানের সামরিক শাসন ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র ‘গণ আন্দোলন’ ৭০’ সালের নির্বাচন, পরিশেষে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষনের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ৩০ লাখ প্রাণ বিসর্জন এবং ২ লক্ষ মা- বোনের সম্ভম আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির জন্য শেখ মুজিবের ৫৫ বছরের জীবনের মধ্যে কারা ভোগে কেটে গেছে ১২ বছর। গ্রেফতার হয়েছেন ১৮ বার এমনকি ফাঁসির মঞ্চ হতে ফিরে এসেছেন দুবার।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক চিত্তরঞ্জন দাস পেয়েছিলেন দেশবন্ধু খেতাব, স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক বাংলার সূর্য সন্তান সুভাসচন্দধ বসু পেয়েছিলেন নেতাজি, ভারত রাষ্ট্রের জনক ‘অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তক মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী পেয়েছিলেন মহাত্মা, হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী গণতন্ত্রের মানসপুত্র, এসব মহামানব তথা নক্ষত্রতুল্য সুর্য্য সন্তানদের তালিকায় যুক্ত হয়ে শেখ মুজিব পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু উপাধি। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রয়ারি স্বৈরশাসক আয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভক্ষ ত্থানের পর শেখ মুজিবকে এ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এরা সবাই নিজেদের মহান কর্ম ও ত্যাগের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে নিবেদিত চিত্র পালন করে ছিলেন তার বিনিময়ে পেয়েছিলেন এসব খেতাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব, রাষ্ট্রধপতি মুজিবের চাইতেও বঙ্গবন্ধু নামটি ১৯৬৯ সাল থেকে বাংলা তথা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছে। মহাকালের যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু নামটি-যতদিন বাংলাদেশ তথা পৃথিবী টিকে আছে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৫-৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর স্বৈরশাসক জিয়া, এরশাদ বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু নামটি মুছে ফেলতে এমন প্রচেষ্টা নেই চালাননি। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তারাই ইতিহাসের আস্থাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মহাকাশের উজ্জল নক্ষত্রের মতো কোটি কোটি বাঙালির হৃদয় মন্দিরে স্থান করে আছেন।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

SUMMARY

474-2.jpg