‘বঙ্গবন্ধুকে নাকি মেরে ফেলেছে!......’

সাব্বির আহমেদ
সেদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিল মেয়েটা। বাসায় অতিথি এসেছিলেন। খালু। ব্যাংকে চাকরি করেন বগুড়ায়। কি যেন অফিসিয়াল কাজে রাজশাহী এসে দুদিন ছিলেন ওদের বাসায়। আর মেয়েটা তো বরাবর দেখে এসেছে – বাসায় আত্মীয়স্বজন আসার পর তারা যখন ফেরার দিন ভোরবেলায় বাস বা ট্রেন ধরতে যায় – সেটা যতসকালেই হোকনা কেন মা তার আগেই উঠে গরম গরম নাস্তা তৈরি করে খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেয়।

সেদিনও তাই মা উঠেছিলেন। স্কুলে যাওয়ার দেরি থাকলেও মেয়েটাও উঠে পরেছিল। খালু চলে যাওয়ার পরও মেয়েটা মায়ের সাথে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের ফ্ল্যাটে ওরা থাকে। বিশাল টানা একটা বারান্দা। মেয়েটা ক্লাশ ফাইবে পড়ে। এখন বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়ালে বাইরের সবকিছুই নিজে নিজে দেখতে পায়।
 
হঠাৎই মেয়েটার চোখে পরল খালু ফ্ল্যাটের ডানদিকে যে সরু পায়ে চলা রাস্তা আছে সেখান দিয়ে দ্রুতগতিতে হেঁটে আসছেন। মা, মেয়ে দুজনই অবাক হয়ে গেট খোলার জন্য এগিয়ে গেল। মেয়েটার বাবার অভ্যাস হল শীত হোক গ্রীষ্ম হোক সক্কালবেলাতেই ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নেয়া। তারপর নাস্তা করে পায়ে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ডিপার্টমেন্টে চলে যান তিনি।
বাবাও অবাক হয়ে এগিয়ে গেলেন।

খালু ভিতরে ঢুকে উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে নিচুগলায় বললেন, ” বুবু – দুলাভাই, এখানে না। ভিতরে চলেন!” ঘরে ঢুকে তেমনই এক উদভ্রান্ত অস্থির গলায় বললেন, “বঙ্গবন্ধুকে নাকি মেরে ফেলেছে!”
এবার সেই উদভ্রান্ত দৃষ্টি চলে এল বাবা – মায়ের চোখে। তাঁরা অবাক গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, ” আরে, কি বলছ এসব? কে বলল তোমাকে?”

খালু বললেন, ” সাইন্স ল্যাব পর্যন্ত যেতে দেখি রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি ঘোড়া প্রায় নাইই। রাস্তার লোকজনই ফিসফাস করে বলছিল এসব কথা। রেডিওতে নাকি ঘোষণা দিচ্ছে!.. …. ও বুবু, রেডিওটা ছাড় তো!”

একাত্তরের কিছু কিছু স্মৃতি মেয়েটার মনে আছে। তারমাঝে একটা মনে পরে খুব সকালে বা সন্ধ্যায় রেডিও খুব আস্তে চালিয়ে, রেডিওর গায়ে প্রায় কান ঠেকিয়ে বাবা, মা, বড়মামা খবর শুনত।
আজও ঘরের মাঝে সেই শুনশান নিরবতা।

তেমনই রেডিওতে চাপা গলায় কথা ভেসে আসা। তেমনই প্রায় রেডিওতে কান ঠেকিয়ে একটা একঘেয়ে অথচ নির্মম গলায় বারবার উচ্চারিত কথা শুনল ওরা, ” আমি মেজর ডালিম বলছি…. …! ”
হত্যার এমন দাম্ভিক ঘোষণা মেয়েটা সেদিন প্রথম শুনেছিল!

বড়রা কি বলছে, কি করছে তা আর কিছুই দেখেনি মেয়েটা। ওর চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। ও দৌড়ে ঘরে যেয়ে ওর স্কুল ব্যাগ থেকে সমাজ বইটা বের করেছিল। দ্রুত হাতে পাতা উল্টিয়ে বের করেছিল ইতিহাসের অংশ। যেখানে পাতার ঠিক মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি। সাদাকালো। কি জীবন্ত, কি মায়াভরা প্রসন্ন মুখ!

মেয়েটা তখনও কোন আপনজনের মৃত্যু দেখেনি। সেই প্রথমে মৃত্যু শোক অনুভব করেছিল। কষ্টে বুক ভরে উঠেছিল। ও কিছুতেই বুঝতে পারছিলনা যে এটা কিভাবে সম্ভব? এত ভালবাসার এত আপন একজন মানুষকেও কি এভাবে মেরে ফেলা যায়?

ব্যাগ থেকে খাতা বের করে সাদা পাতায় পেন্সিল দিয়ে এলোমেলোভাবে প্রিয় সেই নামটা নিয়ে কি কি যেন লিখেছিল বারবার। একসময় দেখল মা পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে ওর খাতার লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

বাবা ওর মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলেছিলেন, “আজ খাতাটা বন্ধ করে তুলে রেখে দাও, মা। পরে কোন একদিন নিশ্চয়ই ভালভাবে এই কথাগুলো লিখতে পারবে!”

সেটা ছিল ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫!
সত্যিকার অর্থে সেদিনই মেয়েটা মৃত্যুশোক প্রথম অনুভব করেছিল!!

লেখক: নাজনীন সুলতানা

অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

473-1.jpeg