হাফিজুল ইসলাম জেমী
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচাতে কর্নেল জামিল শাহাদাত বরণ করেন। সেই জামিলের মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা। বঙ্গবন্ধু হচ্ছে বাংলাদেশ, আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। সেই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন আমার বাবা কর্নেল জামিল আহমেদ। বাবাকে হত্যা করার পর তার লাশটিও ঘাতকরা আমাদের দেখতে দিতে চায়নি। এক পর্যায়ে বিশেষ শর্ত বেঁধে দেয়া হয়, লাশ দেখে কাঁদা যাবে না। আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছিল ঘাতক সেনা সদস্যরা। তাক করা রাইফেলের সামনে বড় বোন, আম্মা আর আমি কাঁদছিলাম। আমার বড় বোন যখন আর্তনাদ শুরু করলেন তখন সেনারা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মাথায় রাইফেল তাক করে বলল, ‘স্টপ, কাঁদলেই শ্যুট করে দেব’। তখনও আপু কাঁদছিলে।
পরে কেউ একজন আপুকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আমার বাবা শাহাদাত বরণ করেছেন,বাবার এ বীরত্ব আমাদের কাছে সবচেয়ে গর্বের। শোক ও ভীতিকর সেই পরিস্থিত এর বর্ণনা দিতে গিয়ে শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদের দ্বিতীয় মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা বারবার কেঁদে উঠছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে বাবা-মায়ের উচ্চ স্বরের কথাবার্তায় আমার এবং বড় বোন তাহমিনা এনায়েত তুন’র ঘুম ভেঙে যায়। গণভবনেই আমাদের বাসা ছিল। মা-বাবার শয়ন কক্ষের পাশেই আমাদের থাকার রুমটি ছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি মা-বাবা বিচলিত, অস্থির হয়ে উঠছেন। পরে জেনেছি, বঙ্গবন্ধু ফোন করেছেন, তিনি বিপদে আছেন। লাল ফোনটা বেজে উঠতেই মা ফোনটা ধরলেন, ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘এই জামিল কই? জামিলকে তাড়াতাড়ি দে।’ মা দ্রুত ফোনটি বাবা কে দিলেন, বাবা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ফোনটি রেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় হামলা হয়েছে।
ওই সময় বাবা দ্রুত সেনা প্রধানসহ একাধিক পদস্থ কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। ওই সময়ের সেনা প্রধান কেএম সফিউল্লাহ ফোর্স পাঠাবেন বলে বাবাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এরপর দ্রুত তৈরি হয়ে সিভিল পোশাকেই বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনের দিকে ছুটে চলেন। মায়ের প্রতি বাবার শেষ কথা ছিল, তুমি আমার মেয়েদের খেয়াল রেখ। আমি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে যাচ্ছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে সোনার দেশ চেয়েছিলেন, সোনার মানুষ চেয়েছিলেন তা আজও কি আমরা পেয়েছি? আমার বাবার আত্মদানের কথা কি নতুন প্রজন্ম জানে। পাঠ্যপুস্তকে কি আমার বাবার বীরত্বের কথা লেখা আছে? আমি শুধু বলতে চাই, গত ১০ বছরে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব (নুরুল ইসলাম নাহিদ) কী করেছেন? কিংবা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীই বা কী করলেন? প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী, ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলাদেশ-বাংলাদেশের ইতিহাস ও আমার বীর বাবাকে নিয়ে সহজ ভাবে বিশদ কোনো লেখা আছে? এইচএসসি এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কি বাবার ইতিহাস পড়ানো হয়? বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, চার নেতা ও বাবাদের মতো বীরদের পূর্ণাঙ্গ একটি সাবজেক্ট নেই। আমরা কখনও বাবার জন্য দোয়া করি না।
বাবা মহান একজন নেতার জন্য, যে নেতা না হলে বাংলাদেশ হতো না, সেই নেতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, শাহাদাতবরণ করেছেন। আল্লাহ বাবাকে বেহেশত দান করবেন, এটাই নিশ্চিত। শহীদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উচুতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, বাবার একটি মিউজিয়াম নেই। বাবার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আছি। বাবার স্মৃতিগুলো নিয়ে একটি ‘শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদ কর্নার’ করার জন্য আর্মি মিউজিয়ামও এগিয়ে আসছে না। এবার আপাকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বলব, বাবার ব্যবহৃত স্মৃতিগুলো যেন বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করেন। ওখানে যেন একটি কর্নার করেন। রাজনীতি নিয়ে শঙ্কায় আছেন জানিয়ে কঙ্কা বললেন, সেনা আর দেশবিরোধী শাসকদের দিয়ে কখনও একটি দেশ ভালোভাবে চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের দল। এ দলটি হোঁচট খেলে স্বাধীনতাবিরোধী এবং ’১৯৭৫-এর ঘাতকরা সক্রিয় হয়ে উঠবে। ’১৯৭৫-এর সেই নির্মম অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী কঙ্কার বয়স তখন ১২ বছর।
তার চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন তনু। কঙ্কার ছোট্ট যে বোনটি তার নাম ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা। ১৫ আগস্টের মাসখানেক পর কর্নেল জামিলের স্ত্রী আনজুমান আরা বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। স্বামীর মৃত্যুর আট মাস পর জন্ম নেয় তাদের কনিষ্ঠ কন্যা কারিশমা জামিল। কঙ্কা জানালেন, বাবার শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে বহু স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছবি আঁকতাম। বাবার পিঠ ছিল আমার ছবি আঁর প্রথম ক্যানভাস। বাবাকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন কঙ্কা। বাবাকে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে তেমন কিছু লেখা নেই। গত ৪ বছর ধরে এ গ্রন্থটি নিয়ে কাজ করছি। বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করবো বলে।