ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
বঙ্গবন্ধু ধার্মিক, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বা সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় মানস গড়ে ওঠার পেছনে অন্তত চারটি প্রভাব কার্যকর ছিলো বলে মনে হয়। এক. পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশ। প্রতিদিন ভোরে বাড়িতে ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত ও নিয়মিত নামাজ পড়ার মধ্যদিয়ে তার জীবন বিকশিত ও বিবর্তিত হয়েছিলো। দুই. বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যলগ্ন। বাঙালির ইতিহাস ধর্মলগ্নতার ইতিহাস, ধর্মান্ধতা বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নয়। বলা বাহুল্য, আপাদমস্তক বাঙালি বঙ্গবন্ধু এই ইতিহাস-ঐতিহ্য-চেতনা সঠিকভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। তিন. বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক চেতনা আত্মস্থ করে এমন একটি বিশ্বাসে থিতু ছিলেন যে, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। ফলে তিনি ধর্মীয় বহুত্বকে গণতান্ত্রিক বহুত্বের সমার্থক বিবেচনা করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যখন বলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান’, তখন বুঝে নিতে হয় তিনি মুসলমানত্বের সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন বাঙালিত্বের; তৈরি করেছিলেন আপন ধর্মীয় মানস। অর্থাৎ বাঙালিত্ব ও ইসলামের অবস্থান ছিলো সমান্তরালবর্তী। মনে হয় এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সেই উক্তির প্রতীক ছিলেন যেখানে বলা হয়েছিলো, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি’। চার. মনে হয় বঙ্গবন্ধু মুসলমান ছিলেন ইসলাম ও কোরআনের মর্মশাঁস আপন চেতনায় ধারণ করে। পবিত্র কোরআনের ২২ নং সুরা হজ্বের ৪০ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘আমি ইচ্ছে না করলে পৃথিবীতে মঠ, মন্দির, গির্জা ও মসজিদ কিছুই থাকতো না।’ অর্থাৎ কোরআনেই ধর্মীয় বহুত্ব স্বীকৃত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের জানুয়ারি থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৩১৪ দিন যে বাংলাদেশ গড়েছিলেন এবং ইসলাম সংক্রান্ত যে অবদান রেখেছিলেন তাতে এই চারটি প্রভাবের প্রতিফলন ছিলো। বক্ষ্যমান আলোচনার উৎস তার বিভিন্ন ভাষণ/বক্তব্য এবং গৃহীত পদক্ষেপসমূহ।
ভাষণ ও বক্তব্য (নির্বাচিত) : ১৯৭০- এর নভেম্বর প্রাক-নির্বাচনি বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। … লেবেল সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসুলে করিম (স.)-এর ইসলাম। যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। … যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়স্তা করে তোলার কাজে’। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়।’ একই বছর ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে তিনি বলেন, ‘ বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই , ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না । ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’
১২ অক্টোবর ১৯৭২ গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। বাংলার মানুষ এটা চায় না। যদি কেউ করে তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাখাত করবে।’ ৪ নভেম্বর ১৯৭২- এ গণপরিষদের ভাষণে একই কথা পুনরায় বলা হয়েছিলো। ১৯৭৪- এর ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু তার আজন্ম লালিত ধর্ম- দর্শন আরও বিস্তৃত করে বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন, তিনি রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান।’উপরোক্ত ভাষণসমূহে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে যে দিকনির্দেশনা ছিলো তার বেশ কটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত. বাংলাদেশ গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হলেও আদর্শগতভাবে হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দ্বিতীয়ত. ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; এর মানে ধর্মীয় বহুত্বের স্বীকৃতি ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। তৃতীয়ত, ধর্মের নামে রাজনীতি ও ব্যবসা নিষিদ্ধ হবে বাংলাদেশে। চতুর্থত, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা যাবে না বা ধর্মান্ধতা চলবে না। সর্বোপরি অনুসৃত ও আচরিত ইসলাম হবে মৌল ইসলামি চেতনালগ্ন।
পদক্ষেপসমূহ : ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরার লক্ষে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাক্কানী আলেম-ওলামাদের নিয়ে ঢাকায় সীরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ’৭৩ ও ’৭৪- এ ১২ রবিউল আওয়াল ব্যাপক আকারে ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী পালন করে। বঙ্গবন্ধু নিজে বায়তুল মোকাররম চত্বরে মাহফিল উদ্বোধন করেছিলেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউ-েশন প্রতি বছর জাতীয়ভাবে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, পালন করে। আরও উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, শব- ই- কদর ও শব-ই-বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। উপরন্তু, উল্লিখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্যে প্রেক্ষাগৃহে ছবি প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইসলামের নামে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বা ইসলামের দোহাই দিয়ে বাঙালি শোষণ-নির্যাতন চললেও পাকিস্তানি শাসনে অবাধে চলমান ছিলো মদ- পান, জুয়া খেলা ও নানাবিধ অসামাজিক কাজ। বঙ্গবন্ধু আইন করে ইসলামবিরোধী এসব কাজ বন্ধ করেন এবং শাস্তির বিধান চালু করেন। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাকিস্তান আমলে ছিলো রেসকোর্স এবং সেখানে রবিবার ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে চলতো বাজি ধরার জুয়া, যা ছিলো উপনিবেশ আমলের ধারাবাহিকতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অনৈসলামিক ঘোড়দৌড় বন্ধ হয়, এবং রেসকোর্সের নামকরণ করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের প্রিয়নবী (স.) বৃক্ষায়ণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি মনে করো আগামীকাল কেয়ামত হবে, তবুও আজ একটি চারা রোপন করো।’ দেখা যায়, নবী (সা.)-এর এমন নির্দেশ অনুসারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বৃক্ষশোভিত করার কাজ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে ।
পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্যে কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিলো না। স্বাধীনতার পর প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের হাজিদের ওপর সৌদি নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন; এবং বঙ্গবন্ধুর আমলে ৬ হাজার ৬০০ জন হজ সম্পন্ন করেন। ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড নামের নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়, যা পাকিস্তান আমলে ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে কোরআন তিলাওয়াত ও তাফসির প্রচার শুরু হয়। উল্লেখ্য, ব্যবস্থাটি মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই চালু আছে।
তাবলিগ জামাতকে একটি অরাজনৈতিক দ্বীনী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বার্ষিক সম্মেলন বা এজতেমার জন্য টঈীতে একটি সুবিশাল প্রাঙ্গন বরাদ্দ দেন। হজের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত তাবলিগ এজতেমা আজ অনুষ্ঠিত হতে পারছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে। উল্লেখ্য,কাকরাইল মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলিগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। বাহাত্তরের আগে মসজিদটি ছিল অপরিসর। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অতিরিক্ত স্থান বরাদ্দ করা হয় ; ফলে মসজিদটি সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানের আকার ধারণ করে। বঙ্গবন্ধু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটি ধর্মকে গুরুত্ব না দেয়া দেশে তাবলিগ জামাতের প্রচার কাজ সম্প্রসারণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সে দেশে বঙ্গবন্ধুর আমলে তাবলিগ জামাতের প্রতিনিধি দল গিয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ দুরূহ কাজটি সম্ভব হয়েছিলো এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার হার্দ্য সম্পর্ক ছিলো। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে এখন তাবলিগ জামাতের যে প্রচার কাজ চলমান তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন একটি ইসলামিক একাডেমি ছিলো। ইসলামের ওপর উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা এ প্রতিষ্ঠানে কোনোদিন হয়নি। পঁচাত্তরের ২৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলাম সংক্রান্ত উচ্চতর গবেষণার জন্যে ইসলামিক ফাউ-েশন প্রতিষ্ঠা করেন। সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এভাবে বর্ণনা করা হয়েছিলো ক. মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা ; খ. মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট এবং সমাজ সেবায় নিবেদিত সংগঠণসমূহকে
আর্থিক সহায়তা দেয়া; গ. সংস্কৃতি, চিন্তা, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদানের ওপর গবেষণা পরিচালনা ; ঘ. ইসলামের মৌলিক আদর্শ বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ,পরমতসহিষ্ণুতা,ন্যায়বিচার প্রভৃতি প্রচার করা ও প্রচারের কাজে সহায়তা করা এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা; ঙ. ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, ইসলামি সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলোর সুলভ প্রকাশনা ও বিলিবন্টনকে উৎসাহিত করা; চ. ইসলাম ও ইসলামের বিষয় সম্পর্কিত বই-পুস্তক, সাময়িকী ও প্রচার পুস্তিকার অনুবাদ করা ও প্রকাশ করা; ছ. ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির ওপর সম্মেলন, বক্তৃতামালা, বিতর্ক ও সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করা; জ. ইসলাম বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার ও পদক প্রবর্তন করা; ঝ. ইসলাম সম্পর্কিত প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া, প্রকল্প গ্রহণ করা কিংবা তাতে সহায়তা করা; ঞ. ইসলাম বিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করা; ট. বায়তুল মোকাররম মসজিদের ব্যবস্থাপনা ও উন্নতি সাধন করা; এবং ঠ. উপরিউক্ত কার্যাবলীর যে কোনোটির ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বা আপতিত কাজ সম্পাদন করা ।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তা ইসলামিক ফাউণ্ডেশন অনুপুঙ্খভাবে পালন করতে পেরেছে তা বলা না গেলেও প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে। এমন কাজের মধ্যে আছে পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ, তাফসির- হাদিসের অনুবাদ, রসুল (স.) – এর জীবন ও কর্মের ওপর রচিত ও অনূদিত বই। ইসলামের ইতিহাস , ইসলামি আইন ও দর্শন, ইসলামি অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবি ও মনীষীদের জীবনী ইত্যাদি। এমন প্রকাশনার সংখ্যা প্রায় চার হাজার । এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার মধ্যে আছে ২৮ খণ্ডে ইসলামী বিশ্বকোষ ও ১২খণ্ডে সীরাত বিশ্বকোষ।
দেশের ভেতরে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতার সুনির্দিষ্ট ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সমান্তরালে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা, সঙ্কটকালে তাদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও মুসলামানকে পরিষেবা দিয়েছেন। ১৯৭৩-এ আরব ইজরায়েল যুদ্ধে অবধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধরত আরব দেশসমূহের সৈনিকদের জন্য ১ লাখ পাউন্ড চা ও ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, অন্যান্য দেশ থেকে পাঠানো মেডিকেল টিমের মধ্যে বাংলাদেশেরটি ছিলো সবচেয়ে বড়। চুয়াত্তরে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (বর্তমান নাম ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) অধিবেশনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সংস্থাটির সদস্য ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বাস্তবধর্মী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। এক. মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ বৈরী ছিলো। কারণ তারা এমন পাকিস্তানি প্রচারণা বিশ্বাস করেছিলো যে, মুক্তিযুদ্ধ ছিলো ভারত-প্ররোচিত ইসলামি সংহতি বিনষ্টকারী একটি অপপ্রয়াস মাত্র। অবশ্য তাদের ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। দুই. যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্যে পেট্রো ডলার প্রয়োজন ছিলো। এ দুটো বিষয় বিবেচনায় নিলে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের বাস্তবতা ও দূরদর্শিতা বোধগম্য হয়।
বঙ্গবন্ধুর ইসলাম ছিলো ইসলামের মর্মশাঁসলগ্ন, ব্যবসায়ি বা রাজনৈতিক ইসলাম নয়। অন্যদিকে তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ধর্মীয় গণতন্ত্র বা ধর্মীয় বহুত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন। বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্য বহুত্বের ও সহিষ্ণুতার। ফলে তার আমলে ইসলামি মূল্যবোধ যেমন সংরক্ষিত ও বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি অন্যান্য ধর্মও অবস্থান করেছে স্বমহিমায়। ধর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয় তা বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন।
লেখক : বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি)