বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ

ড. এম এ মাননান 
ঊনিশশো একাত্তর সালের ৭ মার্চ। মাত্র চৌদ্দ দিন আগে গিয়েছিলোাম একুশের প্রভাত ফেরিতে, অরুণোদয়ের একটু আগে কয়েক গোছা ফুল হাতে নিয়ে, শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স ময়দানের পাশ দিয়ে বর্ধমান হাউজ (বাংলা একাডেমি) পার হয়ে মেডিকেল কলেজের উত্তর দিকের প্রান্ত দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। প্রভাত ফেরির আমেজের মতো তবে একটু ভিন্ন রকমের শিহরণ নিয়ে গিয়েছিলোাম রেসকোর্স ময়দানে সেদিন যে দিনটি তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতির সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিলো। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাজির হয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানে, বক্তব্য শুনতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, যার পরিচিতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে শুধুই ‘মুজিব ভাই’। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সামনে মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সময়টা ছিলো এমন যখন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়াবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। মাত্র পনেরো-ষোলো মাস আগে ১৯৬৯-এ জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন গণআন্দোলনের মুখে।

সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেয়ার জন্য মেজরিটি দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করার পরও অধিবেশনের তারিখ না দিয়ে মাইনরিটি দলের নেতা ভুট্টোর কথা অনুযায়ী তিনি হঠাৎ ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেন। ইতোমধ্যে কসাই নামে পরিচিত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। তিনদিন পর ৫ মার্চ ঢাকার রাজপথ আবার রক্তরঞ্জিত হয়, চট্টগ্রামেই শুধু ২৩৮ জন নিহত হয়, টঙ্গিতে নিহত হয় এক শ্রমিক।
 
সব মিলেয়ে বিক্ষোভে উত্তাল সারা বাংলা, ক্ষোভে-দুঃখে প্রতিবাদমুখর। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনসহ স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করা হয় শহীদ মিনারে ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠি মিছিল বের করে রাজধানীর সড়কে। এমন এক ঝন্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে বাঙালির প্রাণপুরুষ শুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরিহিত (যা মুজিব কোট নামে বিখ্যাত হয়ে উঠে) বঙ্গবন্ধু সেদিন রেসকোর্স ময়দানে এলেন, দৃপ্তপায়ে মঞ্চে উঠলেন, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে চারদিকে হাত নেড়ে সবাইকে অভিবাদন জানালেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো জয় বাংলা স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে শুরু করলেন তার অমিয় ভাষণ। আমার হলের বন্ধুরাসহ একেবারে মঞ্চের সামনে বাঁশের ঘের দেয়া সীমানার পাশেই বসা ছিলাম। তাই মঞ্চটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখলাম হাত নাড়া শেষ হতে না হতেই বক্তব্য শুরু করলেন তিনি। টানা আঠারো মিনিট বক্তব্য রাখলেন কোনো কিছু না দেখেই। এরই মধ্যে মাথার ওপর দিয়ে একটি সামরিক হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গেলো। এ সময় সারা ময়দানের জনসমুদ্রে শুরু হলো গগনবিদারি জয় বাংলা স্লোগান। মানুষের সমুদ্রে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারলো না সে হেলিকপ্টার। উল্টো মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়লো বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। হেলিকপ্টারটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। জিমখানা বরাবর (চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের) রাস্তায় উঠে দেখি সারা রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ, প্রায় প্রত্যেকের হাতে তিন-চার ফুটের লাঠি। সেদিন ঢাকা ছিলো মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।

একটি জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টির সহায়ক, স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়নে মহাআলোড়নকারী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৭ মার্চের ভাষণকে কেউ কেউ বলেছেন ‘স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের মহাকাব্য’। দীর্ঘদিনের নিপীড়িত বাঙালিকে সশস্ত্র করে তুলেছিলো এ ভাষণ। শ্রদ্ধার সাথে বরিত হয়েছে এ ভাষণ দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক মহলে। তফসিল আকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানে। এগারোশো পাঁচ শব্দবিশিষ্ট এতো ছোট ভাষণটি নিয়ে কেন বিশ্বব্যাপী এতো উৎসাহ? তার মূল কারণ যা আমার মনে হয় : ভাষণটি ছিলো অলিখিত হলেও প্রাঞ্জল-স্বতঃস্ফূর্ত, বক্তব্যের মোহনীয়তায় অসাধারণ, মাধুর্যম-িত বাচনভঙ্গি আর বাক্যবিন্যাসের কারণে কাব্যময়, বঙ্গবন্ধুর হৃদয় থেকে উৎসারিত আমজনতার আশা-আকক্সক্ষার প্রতিফলন, সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির জন্য প্রেরণাদায়ক, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির ঈঙ্গিতবহ।

তিনি যখন তার ভাষণে বলেন : ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’, তখন বোঝা যায় তিনি নিজের কথা বলছেন না, বলছেন সকলের কথা, সকলের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের কথা। ভাষণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে পরাধীন, তাই তাদের প্রয়োজন এ রকম পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এ বিষয়টি বাঙময় হয়ে উঠে যখন তিনি বলেন : ‘এ দেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে’। তিনি এ ভাষণে দৃঢ়তার সাথে স্পষ্ট করে দেন, শাসকদের সকল দাবিই মানতে হবে (দাবিগুলো ৬ দফার মধ্যেই নিহিত ছিলো)। চারটি শর্তের মধ্যে বেঁধে ফেললেন শাসকদের : ১. সামরিক আইন উঠিয়ে নেয়া, ২. সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, ৩. বাঙালি হত্যার তদন্ত সম্পন্ন করা এবং ৪. নির্বাচনে জয়লাভ করা দলের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ দাবিগুলোকে মাথায় রেখে তিনি গর্জে উঠেন : ‘আমাদের দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তিনি বুঝিয়ে দিলেন ক্ষমতার মোহে তিনি রাজনীতি করেন না, তিনি রাজনীতি করেন জনগণের জন্য। এমনটি শুধু বঙ্গবন্ধুর মতো বড় মাপের নেতাই বলতে পারেন : ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন : ‘আমি পরিষ্কার করে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফোজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ আর এভাবেই তিনি সবার অজান্তে হয়ে উঠেন সকলের হৃদয়ের মণি আর নিজেই হয়ে উঠেন ‘কার্যত সরকার’ (ডি ফ্যাক্টো গভর্নমেন্ট)। তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, তার হুকুমই চলবে যদি পাকিস্তানি শাসকরা দাবি মেনে না নেয়। তাই তিনি নির্দেশ দেন : ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না।’ কার্যত সব শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়ে তিনি সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান : ‘আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমাদের এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততোদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো – কেউ দেবে না।’ চাকরিজীবীদের কষ্টের কথা তিনি ভুলেননি। তারা যেন কষ্ট না পায় বেতনের অভাবে সেজন্য তিনি বললেন : ‘দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারে।’

সব কিছুর শেষে তিনি কৌশলে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। প্রয়োজনে গেরিলা কায়দায় শত্রুকে মোকাবেলা করার ঈঙ্গিত দেন : ‘আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা না বলে ঘুরিয়ে বলেন : ‘আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।… সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা মরতে যখন শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ তার এ কথার অন্তনিহিত অর্থের সাথে মিলে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গ্রেট বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ভাষণের কিছু অংশ। চার্চিল তার বিখ্যাত ভাষণে বলেন : আমারা যুদ্ধ করবো সাগরে-মহাসাগরে, যুদ্ধ করবো আকাশে… আমরা যুদ্ধ করবো সমুদতটে, মাঠে ময়দানে আর রাস্তায় রাস্তায়। যুদ্ধ করবো আমরা পাহাড়ে, করবো না আত্মসমর্পণ কখনই।’ বঙ্গবন্ধু শাসকদের একদিকে দিয়েছেন অভয়বাণী, আরেক দিকে অকুতোভয়ে সাবধান করে দিয়েছেন : ‘তোমরা আমার ভাই, তেমারা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।… কিন্তু আমার বুকের ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করো না।’

মোনাফেকদের ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন সবাইকে এবং একই সাথে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সাবধান করে দিয়েছেন : ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

ভাষণে স্পষ্ট করে দিলেন তিনি, আরো কঠিন সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে সংগ্রামের জন্য। বেশি কিছু বলেননি যাতে আবার আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে হামলা করার সুযোগ না নিতে পারে শাসকরা। সূক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী জাতির দিক-নির্দেশক বুঝতে পেরেছিলেন, শাসকরা যদি একবার প্রমাণ করতে পারে যে ‘বাঙালিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তাহলে তারা বিদেশিদের সমর্থন পাবে। আর মেজরিটি বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে যাবে কেন? বিচ্ছিন্নতাবাদী যদি হতেই হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানি মাইনরিটিরা হবে। এ প্রেক্ষাপটে তিনি ঘোষণা দেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ছিলো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই রেসকোর্সের জনসমাবেশে হামলা চালাবে। এ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে বঙ্গবন্ধু এ ভাষণের মাধ্যমে একদিকে কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর কৌশল ছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদী না হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। সেদিন তিনি সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ছিলেন, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে চারটি শর্তের বেড়াজালে শাসকদের চক্রান্তকে আটকে দিলেন এবং সামরিক শাসকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না।

মুক্তিকামী উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে অস্থিরচিত্তে অপেক্ষমাণ, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু চির উন্নত শিরে সুস্পষ্ট দৃঢ়তায় উচ্চারণ করেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এ অংশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ছিলো। অন্তরের গভীরে যা বিশ্বাস করতেন, বক্তৃতায় তিনি তাই ব্যক্ত করেছেন। এ ভাষণ একটি শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত জাতিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ, দাঁড় করিয়েছে জাতীয় মুক্তির মোহনায়। তিনি ভাষণ শেষ করলেন ‘জয় বাংলা’ দিয়ে, কালজয়ী দুটো শব্দ দিয়ে যে শব্দযুগল নয় মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল বাঙালিকে আপ্লুত করে রেখেছিলো, যে শব্দযুগল বাঙালি হৃদয়ে চিরকাল বহমান নদীর স্রোতের মতো ছলছলিয়ে চলমান থাকবে।

এ ভাষণটির শব্দচয়ন, ভেতরের আকুলতা, বাণীর বলিষ্ঠতা, নেতার হৃদয়ের গভীর থেকে উত্থিত বহ্নিশিখা, কবিত্বময় গদ্যের অপূর্ব ছন্দ, আপন মানুষকে ভালোবাসার পরশ ছড়ানো ঝংকার, সবকিছু মিলিয়ে অশ্রুতপূর্ব কথামালা বিশ্বস্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর নিকট থেকে। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এমওডব্লিউতে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এটি ইউনেস্কো পরিচালিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র ঐতিহ্যের তালিকা। দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এ তালিকা তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ’ (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ প্রোপার্টি) হিসেবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণরূপে আজ বিশ্ব পরিম-লে আদৃত।

এ ভাষণটির ভিত্তিতে লন্ডনের সানডে টাইমস্ পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে নাম দিয়েছে ‘এ পোয়েট অব দ্যা পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি)। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন ‘মহাকাব্যের মহাকবি’। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুক্তিকামী জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ একটি অগ্নিগর্ভা প্রেরণা যা যেকোনো মানুষের হৃদয়কে উদ্বেলিত করার পাশাপাশি সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করে।

লিখিত কোনো ভাষণ ছিলো না এটি। তবুও এটি ভাষণ নয়, মহাকাব্য হিসেবে অভিহিত। আর এ মহাকাব্যের মহানায়ক হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, আমাদের জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মহান মানুষের নামটি আর ভাষণের অনুরণন চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে থাকুক, এ কামনা থাকবে সর্বদাই।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

449-1.jpg