একটি পতাকা উত্তোলনের গল্প

সৈকত ভৌমিক

চারদিকে তখন মিছিলো হচ্ছে, স্লোগান হচ্ছে। আমার হাতে পতাকা। মঞ্চে তখন ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব সভা পরিচালনা করছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অন্য ছাত্রনেতারাও তখন মঞ্চে। জনসমুদ্রের মাঝখান থেকে আমরা মঞ্চের কাছে যাই পতাকা নিয়ে। মঞ্চের সামনে পৌঁছানোর পরে জাহিদ আমার কাঁধ থেকে পতাকা দ-টি নিয়ে সভা পরিচালনায় থাকা আ স ম আবদুর রবের হাতে তুলে দেন। তিনি মঞ্চে উপস্থিত সবার সামনে পতাকাটি নাড়িয়ে যখন দেখাচ্ছিলেন, তখন মঞ্চে উপবিষ্ট সব নেতা দাঁড়িয়ে পতাকাকে সম্মান জানান। মানচিত্রখচিত পতাকা দেখে সবাই মুহুর্মুহু স্লোগান তুলছিলো সেই সময়ে স্বাধীনতার দাবিতে। রব ভাই পতাকাটি বেঁধে দেন মঞ্চের এক কোণায়।
 
প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সেই ক্ষণটির কথা সারাবাংলাকে এভাবেই তুলে ধরছিলেন মহিবউল ইসলাম (ইদু)। সবার প্রিয় ইদু ভাই।

পতাকা তৈরির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে মহিবউল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার প্রথম যে পতাকা আমরা বলি, সেটি কিন্তু আসলে তৈরি হয়েছিলো আরও আগে। কিছুটা অন্য রূপে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন একটি কুচকাওয়াজের সময় এই পতাকা ব্যবহার করে ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। তখন পতাকায় ছিলো সবুজের মাঝে লাল। অনেকটা আমাদের বর্তমান পতাকার মতোই।

উত্তাল সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মহিবউল ইসলাম বলেন, ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলার সব স্তরের মানুষ। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) খুব সম্ভবত কমনওয়েলথ বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা চলছিলো। সেই সময়ে অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে সবাই রাজপথে নেমে আসে। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালীন ইকবাল বর্তমান জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পরিষদ নিউক্লিয়াসের একটি জরুরি সভা বসলো। এমন সময় শোনা যায় হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সম্মেলন করবেন। আমি সাংবাদিক সম্মেলনে কী সিদ্ধান্ত হয়, তা জানার জন্য হোটেলের সামনে যাই। শুনলাম ৩ মার্চ বিকাল ৩টায় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ প্রতিবাদ সভা পল্টনে।

পূর্বাণী থেকে বের হয়ে গেলাম ফকিরারপুলে বাদশা হোটেলে খাওয়ার জন্য। সেখানে জাহিদের সঙ্গে দেখা। আমার বন্ধু শেখ জাহিদ ছিলো ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১-এর আন্দোলন সংগ্রামের দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। একইসঙ্গে আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতি পর্বের বিভিন্ন গোপন রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতাম। জাহিদের সঙ্গে সেখান থেকে বের হয়ে আমরা আসি ইকবাল হলে। সেখানে জাহিদকে ওপরে যেতে বলা হয় মিটিংয়ে যোগ দিতে হাসানুল হক ইনুর রুমে। জাহিদ চলে গেলো সেই জরুরি সভায় যোগ দিতে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিচতলায় পোস্টার লেখার কাজে কমান্ডো রফিকসহ। এর মাঝে দেখলাম, রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার দিকে কাজী আরেফ ভাই, সিরাজুল আলম খান ভাই ও রাজ্জাক ভাই বের হয়ে গেলেন হল থেকে। ৩০-৪০ মিনিট পরে তারা ফিরে আসেন ও ওপরে চলে যান মিটিংয়ে। তারও আধা ঘণ্টা পরে রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার দিকে জাহিদ নেমে এসে বললো, বলাকা ভবনে যেতে হবে। ছাত্রলীগের মূল কার্যালয় সেখানেই ছিলো। কার্যালয়ে গিয়ে ছাত্রলীগের মাসুদ আহমেদ রুমি ভাইকে দেখতে পাই, যিনি দৈনিক বাংলা পত্রিকার স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন। তিনি খবরের জাহিদকে কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট দিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে আমাকে জাহিদ পতাকা সম্পর্কে বললো। তবে তার সঙ্গেই যে সে পতাকা, তা বলেনি। বললো, পতাকা পরের দিন সমাবেশে তোলা হবে। আরও বললো, রাজ্জাক ভাইরা পতাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন অনুমোদনের জন্য। বঙ্গবন্ধু তখন তাদের নাকি বলেছিলেন কিছু কৌশলগত কারণে পতাকায় পরিবর্তন আনতে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা দিয়ে একটা মানচিত্র দেয়ার কথাও বলেছেন। এই সময় হলে ফিরে আলোচনা হয় মানচিত্র কে আঁকবে, তা নিয়ে। ইনু ভাই বললেন, শিবু তো (শিবনারায়ণ দাস) ঢাকাতেই আছে । ১ তারিখ রাতেই কাজী আরেফ ভাই তাকে বুঝিয়ে দেন পতাকার ওপরে মানচিত্রের ছবি এঁকে দিতে। শিবনারায়ণ দাস সেই পতাকাতে মানচিত্র আঁকেন। আর সেটা রং না শুকানোর আগে কাঁচা অবস্থাতেই আমরা নিয়ে যাই। এভাবে কথা বলতে বলতে আমরা এগিয়ে আসি মৌচাক চত্বর। ঢাকা নগর ছাত্রলীগের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি কাউছারসহ অনেককেই দেখলাম। সবাই মিলে আমরা সেখানে পাকিস্তানি শাসকদের ছবি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানালাম। সেখানের গোলচক্করের চার পাশে আমি আটটি ব্যানার বানিয়েছিলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।’এরপরে আমরা চলে আসি গুলবাগে। জাহিদের বাসা আমার বাসার সামনেই। সে আমাকে তখন বললো, ‘দোস্ত আমার ওপরে তো একটা দায়িত্ব পড়েছে, কিন্তু আমি বুঝছি না কী করবো?’ ও কথাটা বললো, কারণ রেডিওতে কিছুক্ষণ পর পর খবরে বলা হচ্ছিলো সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা ততোক্ষণে কাউসারকে বলে দিয়েছি সমাবেশে যাওয়ার জন্য লোকজন নিয়ে আসতে। ওদিকে গুঞ্জন ছিলো, পতাকা বহনকারীকে দেখা গেলেই গুলি করে মারা হবে। বলেই চলেছেন মহিবউল ইসলাম ইদু। বলেন, তখনও এদিকে বিশ্বরোড হয়নি। এদিকটাতে সবজি বাগানই ছিলো। জাহিদ জানালো গুলবাগে রেললাইনে পরদিন সবাইকে আসতে বলা হয়েছে। দশটার দিকে মিটিং তার আগেই পৌঁছতে হবে। জানি না কী চিন্তা করে, কিন্তু জাহিদ আমাকে বাক্সটা দিয়ে বলে এখানে পতাকাটা আছে। কাল সকালে এটা নিয়ে আসিস। এরপর ২ মার্চ এলো। সকালে প্রথম পতাকা হাতে মিছিলো নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ আরো দৃঢ় হয়ে উঠলো মহিবউল ইসলামের। তিনি বলেন, সকালে নাস্তা খেয়ে আটটার দিকে আমরা রওয়ানা দেই এবং জড়ো হতে থাকি গুলবাগের রেললাইনে। দেখলাম কাউছার ইতিমধ্যে শ’খানেক মানুষ নিয়ে চলে এসেছে অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হিসেবে। জাহিদও চলে এলো। তখন দোকানে এখনকার মতো শাটার সিস্টেম তেমন ছিলো না। বাঁশ দিয়ে দোকানের সামনের দিকে ঝাঁপ ঝুলিয়ে রাখা হতো। সেখানে একটা বাঁশ নিলাম। জাহিদ পতাকাটা সেই বাঁশে বেঁধে দিলো। আমরা সেই পতাকা নিয়ে সেখানেই স্লোগান ধরলাম ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব’সহ নানা স্লোগান।

জাহিদের নেতৃত্বে আমরা রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। মিছিলের সামনে পতাকা নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে রেললাইন ধরে রামপুরা সড়কে উঠলাম। রামপুরা সড়ক থেকে মৌচাক মোড় সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর দিয়ে বেইলি রোড তখনকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধার কাছাকাছি মিছিলো পৌঁছলে সেখানে কর্তব্যরত পাকিস্তানি চার-পাঁচজন সৈনিক আমাদের সামনে চলে আসে। ততোক্ষণে আমাদের মিছিলে প্রায় হাজারখানেকের সমাগম। এই অবস্থায় একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আমাদের যাওয়ার অনুমতি দেয়। হয়তোবা তিনি ভাবছিলেন এই মিছিলে গোলাগুলি করলেও উনারা সংখ্যাতে কম থাকায় আমাদের সাথে সেই মুহুর্তে বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন না। জাহিদের সাথে পতাকাটি আমার হাতে থাকা অবস্থাতে আমি সামনের দিকে নিয়ে এগিয়ে যাই মিছিল করে। রমনা পার্কের ভেতরে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে রেসকোর্সের ময়দানের ভেতর দিয়ে আমরা টিএসসি চত্বরের সামনে দিয়ে কলাভবন চত্বরের আমতলায় পৌঁছি। আর এর পরই তো সমাবেশে সেই উত্তাল মুহুর্তগুলো।

মহিবউল ইসলাম আরও বলেন, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে হবে এটা কিন্তু নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম। ইনু ভাই, আম্বিয়া ভাই, মার্শাল মনি ভাইও সঙ্গে ছিলেন। আমি এখানে যুক্ত হই ’৬৬ সনে একজন কর্মী হিসেবেই। বঙ্গবন্ধুকে তখন তারা বলতেন, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়া সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, ‘দেখ তোরা তোদের কাজ চালিয়ে যা। আমার প্রচ্ছন্ন ছায়া থাকবে তোদের প্রতি। কিন্তু আমি যেহেতু উন্মুক্ত রাজনীতি করি তাই আমাকে অনেক কিছুই ম্যানেজ করে করতে হয়।’ আসলে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স পৃথিবীর কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি। এটা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন। আর সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশ, একটি স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে সবাই গর্ব করতে পারি। সূত্র : সারাবাংলা

SUMMARY

446-1.jpg