বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণ এবং আমরা


মোতাহার হোসেন

১৯৭৫ সালের শোকাবহ আগস্টের আগেও আমাদের জীবনে আগস্ট আসত। আর ৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে প্রতি বছর এই দিনটি আসে আমাদের কাছে শোকাবহ, বেদনা বিধুর দিন হিসেবে। এদিন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার পাশাপাশি নিজেদের আত্মশুদ্ধি, আত্মপোলব্ধি, অনুশোচনার দিনও বটে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি ১৫ আগস্টের ঘাতকের বুলেটে নিহত তার পরিবারের অপর সদস্যদের। বাংলা ভাষা, বাঙালি ও বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। এক অর্থে এই তিনটি শব্দের সমার্থক হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। পিতা মুজিবের জন্মই হলো বাঙালিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ, মানচিত্র উপাহার দেওয়ার জন্য। বাঙালিকে ধীরে ধীরে স্বাধিকারকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু এই বাংলা যুগে যুগে অনেক নেতা এসেছেন; যেমন—শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী তাঁদের প্রত্যেকেই দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন স্বাধীনতা এনে দিলেন। অবশ্য শত বছর আগে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেন এবং তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনস্বরূপ তাঁদের দেখানো পথেই বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এ সংগ্রামের সফল সমাপ্তি ঘটান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

পৃথিবীতে অনেক ক্ষণজন্মা এবং মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে; যেমন-মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, মোস্তফা কামাল পাশা। এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। ঠিক তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলার। দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানিদের শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত এবং উদ্বুুদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধু। এ পর্যায়ে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, পরে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় অবশেষে একাত্তরের মহান মুক্তি। এর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এলো বাঙালির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—লাখো জনতার উত্তাল জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শোনালেন সেই অমর বাণী, ‘... এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’...তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে,... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো—এ দেশের মানুষকে মুক্ত করো ছাড়বো ইনশাল্লাহ...।’

দার্শনিক হেগেলের মতে, ‘একজন মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা’ যা বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন। তিনি বাঙালি জাতির পিতা একদিনে হননি। এ জন্য তাঁকে যৌবনের এক যুগেরও বেশি সময় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে, ফাঁসির কাষ্ঠে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধকালে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কারাগারে তাঁর সেলের পাশেই কবর খুঁড়ে ছিলেন। তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতও ছিলেন। সেদিন পাকিস্তানি জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধুর একটিই দাবি ছিল, তাঁর লাশটি যেন তারা তাঁর প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের মাটিতে প্রিয় দেশবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সব সময় যে মানুষটি বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করতেন, তাঁকেই স্বাধীন দেশে সপরিবারে হত্যা করা হলো।

এরপর থেকেই এ জাতি বীরের জাতির পাশাপাশি বিশ্বঘাতকের জাতি হিসেবেও বিশ্বদরবারে আসীন হলো। এ কলংক জাতিকে দীঘদিন ধরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রাজনৈতিক হত্যার বহু নিদর্শন রয়েছে। যেমন : ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চিলির আলেন্দে, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি প্রমুখ। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-টি বিশ্বের অদ্বিতীয় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের তীর্থভূমি ঐতিহাসিক ‘ধানমন্ডির ৩২ নম্বর’ বাড়িতে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, একে একে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও পরিবারের সব সদস্যকে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত রাজনৈতিক হত্যাকা-। এমনকি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র ৯ বছরের রাসেলকে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন কেউ যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।’ এ জাতির অভিশাপস্বরূপ হলেও সত্যিই জাতির পিতা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রথম প্রাণ দিলেন।’ ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করলেই তার নাম চিরতরে মুছে যাবে, স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হবে। কিন্তু তাদের ভাবনা এতই ভুল ছিল যে, সময়ের পরিক্রমে দেখা যায় জীবিত মুজিবের চেয়ে আজ মৃত মুজিব বহু গুণ শক্তিশালী।

জাতির বঙ্গবন্ধুর রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে লক্ষ করা যায় কীভাবে তিনি তিল তিল করে স্বাধিকারকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপদান করেছেন। তাঁর সমগ্র জীবনই ছিল বাঙালির জন্য উৎসর্গকৃত। তা সত্ত্বেও জেলগেটে বেগম ফজিলাতুন্নেসার কাছে আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা-১)

যত দিন বাংলাদেশ আছে এবং থাকবে। তত দিন আলোক উজ্জ্বল সূর্যের মতো আমাদের পথ দেখাবেন বঙ্গবন্ধু। এই অবিসংবাদিত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। প্রত্যাশা করছি, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আত্মস্থ করা ও সে অনুযায়ী নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য তার যোগ্য উত্তরসূরি দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা বিনির্মাণ করাই হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার উৎকৃষ্ট প্রতিশোধ।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক

SUMMARY

435-1.jpg