ডা. এস এ মালেক
আসলে মুজিবনগর বলে কোনো স্থান মেহেরপুরে ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে; মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রয়োজনে এবং বহির্বিশ্বে বাঙালি জাতির ভাবমূর্তিকে তুলে ধরার জন্য এ সময়ে ‘প্রবাসী’ সরকার গঠনের কারণেই স্থানটি বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত হয় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার আদেশ’। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ‘প্রবাসী’ সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম অনুযায়ী ওই সরকারের নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর সরকার’। ওই সরকারের প্রধান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকার কারণে তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে।
কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর ছিল তখন হানাদারমুক্ত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বহু দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং আইনসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর সরকার’ শপথ গ্রহণ করেন। এ সরকার বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক, আইনসম্মত ও বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৭০ সালে জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শান্তিপূর্ণ বাঙালির ওপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনী এবং পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালায় পূর্ব বাংলায়। বঙ্গবন্ধু তখন বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি গ্রেফতার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ ২০-২১ দিনের মধ্যেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সীমানা অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারত সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সরকার এবং ওই সরকারের প্রধান কার্যালয় ছিল ৮নং থিয়েটার রোড, কলকাতা, ভারত। কিন্তু সরকার গঠন করা হয় স্বাধীন দেশের মাটিতেই। এ সরকারের ধারাবাহিকতায় পরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার পরিচালিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ওই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পৃথিবীর অনেক দেশে বিপ্লবীরা স্বদেশের বাহিরে গিয়ে সরকার গঠন করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছেন। ওই সরকারের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা অধিকাংশই ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা বা সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত। তাদের চরিত্র ছিল বৈপ্লবিক। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম এই যে, এ সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই ওই সরকার গঠন করেছিলেন। গোটা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল একটি নির্বাচিত সরকার। যে যৌথ সামরিক কমান্ড মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল; তারাও ছিল মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূল না থাকার কারণে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সামরিক কমান্ডের প্রধান ছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। মন্ত্রিসভা পদ্ধতিতে সরকারের প্রকৃতি ছিল এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। মন্ত্রিসভা নিয়মিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তার দায়িত্ব সূচারুভাবে পালন করত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। প্রথমত. পাক বাহিনী যখন দেশের ভেতরে ছাত্র যুবকদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছিল, তখন ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠিত হওয়ায় তারা আশার আলো দেখতে পায়। দলে দলে তারা ভারতে এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন করে। এখানে তাদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
দ্বিতীয়ত. মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন সেক্টর ও গেরিলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব মুজিবনগর সরকার নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে।
তৃতীয়ত. জনগণের মনোবল ঠিক রাখার জন্য এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুণœ রাখার জন্য ‘মুজিবনগর সরকার’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালায়। স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গানগুলো এবং ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।
চতুর্থত. ‘মুজিবনগর সরকার’ নানা প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও একটি বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুলেছিল। এরূপ একটা মুক্তাঞ্চল ছিল ৯নং সেক্টরে মেজর জলিলের নিয়ন্ত্রণে। এর প্রধান কার্যালয় ছিল গোপালগঞ্জের ওরাকান্দা ঠাকুরবাড়ী। সেখান থেকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা, কাশিয়ানী, মকসুদপুর প্রতিষ্ঠিত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শাসন। ৮ ডিসেম্বর এ সাব-সেক্টরের নেতৃত্বে গোপালগঞ্জ স্বাধীন হয়। একজন বেলুচ ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ২৭ জন সৈন্য বন্দি হন। ৯ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে প্রতিনিধিরা স্বাধীন দেশের সরকার কায়েম করেন। গোপালগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের নিয়মিত সরকার গঠন করা হয়। তখন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন একজন সিএসপি আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসক ছিলেন ক্যাপ্টেন হালিম (ছদ্মনাম), ডা. এস এ মালেক। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সুদীর্ঘ কয়েক মাস ধরে হানাদার বাহিনীর সদস্য আবদ্ধ ছিল আলফাডাঙ্গায়। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে বেসামরিক প্রশাসন জনগণের সব সমস্যার সমাধান করত। এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে সক্ষম হন। যুদ্ধের ৯ মাস মুক্তাঞ্চলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করত। প্রথমদিকে পাক বাহিনী অপরাধে লিপ্ত হলেও পরবর্তীতে ওই অঞ্চল ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। এমনকি তখন বোয়ালমারী থেকে ‘জয় বাংলা’ নামক একটা পত্রিকা ছিল। গোপালগঞ্জে প্রথম ট্রেজারি খুলে ওই সরকার স্বাধীনতার শত্রু, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মুসলিম লীগ নেতার সব সম্পত্তি বিক্রি করে গোপালগঞ্জে ট্রেজারি খোলা হয়। মাত্র সাত দিনের ভেতর তিনটি মামলার বিচার করা হয়। ৯নং সেক্টর বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা এবং খুলনা ও ফরিদপুর জেলার অংশ নিয়ে মে মাসের প্রথমদিকে এ সেক্টর গঠিত হয়। মেজর এম এ জলিল সেক্টর প্রধান ও তিনটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা হলেনÑ ১. মেজর এম এ জলিল ২. ক্যাপ্টেন মো. শাহজাহান ৩. লে. মেহেদী আলী ইমাম ৪. লে. এ এইচ জিয়াউদ্দিন ৫. লে. আহসানউল্লাহ ৬. লে. শচীন্দ্রনাথ কর্মকার ৭. লে. মোহাম্মদ আলী ৮. ক্যাডেট এ এস এম শামসুল আরেফিন। সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০, কিন্তু গণবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ হাজার। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ৯নং সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার শত্রু পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে ও দেশ দ্রুত শত্রুমুক্ত হয়। তারা দেশের অভ্যন্তরে গেরিলাযুদ্ধ বেইসগুলোতে অবস্থান করে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অপারেশন চালিয়েছে। ফরিদপুরের হাবিলদার হেমায়েতের অধীনে এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে এ বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে। ফরিদপুর জেলার অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মুক্তি বাহিনীর দল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ ও নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার বীরত্বপূর্ণ অবদান তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।
ক্যাপ্টেন সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ বাবুলকে মেজর জলিল তিনি যেন প্রশাসককে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের আত্মত্যাগ ও মহান কর্মকান্ড চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ইমদাদুল হক, নুরুল কাদের চুন্নু, ইসমত কাদের গামা, শাহ মো. আবু জাফর, হাসান মাস্টার প্রমুখ। আজিজ মোল্লা, আলতাফ-চাঁদের হাটে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও এই প্রেক্ষাপটে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে সারা দেশের মতো আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি সম্ভবত এপ্রিলের শেষের দিকে শেখ নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গমন করি এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তার কাছে ২৮ দফা কার্যবিবরণী তুলে ধরি। তিনি এটি গ্রহণ করেন ও সন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করবেন বলে জানান। বিশেষ করে আমার একটি প্রস্তাব ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেসব এলাকায় পরাজিত হবে, ওইসব এলাকার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে কর্তৃত্ব আমাদের সম্পূর্ণভাবে অনুকূলে আসবে। এর জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষণিক মেজর এম এ জলিলকে লিখিত নির্দেশ প্রদান করেন এবং আমাকে ফরিদপুরের মুক্তাঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগদান করেন ও সাব-সেক্টর কমান্ডার নূর মোহাম্মদ যেন সর্বাত্মকভাবে আমাকে সহযোগিতা করেন। ভারতে আমি ১৯ দিন অবস্থান করি ও পরবর্তীতে ২০০ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে প্রবেশ করি।
পঞ্চমত. স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, লক্ষ্যে, পাক বাহিনীর হিংস্রতা ও গণহত্যা, মুক্তি বাহিনীর সাফল্য ইত্যাদি বহির্বিশ্বে প্রচার করে জনমত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকার প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক মিথ্যাচার রোধে দেশ ও জাতির সম্মুখে একটি তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজনবোধ করছি। ২৬ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পৌঁছে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য দেন তা নিম্নরূপ :
“In East Pakistan a non-cooperation and disobedience movement was launched by the awami league and matters took a very serious turn…….Sheikh Mujibur Rahman’s action of starting his non-coorperation movment is an act of treason. He and his party have lefied the lawful authority for over three weeks……..His obstinancy, obduracy and absolute refusal to talk sense can lead to but on conclusion- the man and his party are enemies of Pakistan and they want East Pakistan to break away completely from the country. He has attacked the solidarity country this crime will not go unpunished.”
বঙ্গানুবাদ :
(পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল এবং যা ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে... ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের শুরু করা অসহযোগ আন্দোলনটি দেশদ্রোহিতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তিনি ও তার দল এভাবে বৈধ কর্তৃপক্ষকে অবজ্ঞা করেছে প্রায় ৩ সপ্তাহের অধিককাল... তার দুর্দমনীয়তা/একগুঁয়ে মনোভাব স্বাধীনতার প্রশ্নে ও আলোচনায় অনীহার ফলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এই ব্যক্তি ও তার পার্টি পাকিস্তানের শত্রু এবং তারা চায় দেশ (পাকিস্তান) থেকে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক। তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অন্ডতার মূলে আঘাত হেনেছেনÑ এহেন অপরাধের শাস্তি না হয়ে পারে না)।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বোস্টন গ্লোব-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ওয়াশিংটন ডিসি। স্থানীয় সময় বেলা ৩.০৩ মিনিট থেকে ৩.৩২ মিনিট পর্যন্ত ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক হয়। ড. হেনরি কিসিঞ্জার এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় ওয়াটারগেটখ্যাত সিআইএর পরিচালক রিচার্ড হেলমেস তথ্য দেন, গোপন বেতার বলেছে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয়তাবাদী মহান নেতা ছিলেন। তিনি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য সব সময় ভাবতেন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলনের ফসল মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ৬ দফার প্রশ্নে আপস না করায় পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালিদের চিরদিনের জন্য দাসত্ব আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। যখন সংসদ অধিবেশন বসতে দেওয়া হলো না, দিন-তারিখ ঠিক করেও তা অনির্দিষ্ট দিনের জন্য স্থগিত করা হলো, তখন বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বিশেষ করে ৩ মার্চ দিন ধার্য করেও তা বাতিল করায় বুঝতে বাকি রইল না যে, তখন বাঙালির কী করা প্রয়োজন। মূলত ৭ মার্চের ভাষণে তখন বাঙালির কী করণীয়, সে কথাই বলা হয়েছিলে। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণকে বুঝিয়ে দিলেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পর্যায় শেষ হয়েছে, জনগণকে এখন সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে হানাদার বাহিনীকে চিরতরে এ দেশের মাটি থেকে উৎখাত করে দেশ স্বাধীন করতে হবে। সে লক্ষ্যেই তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। প্রায় ৩ সপ্তাহ এ আন্দোলন চলল। ২৫ মার্চের কালোরাতে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ চালাল। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যার স্বাধীনতা ঘোষণার নৈতিক, আইনগত ও বৈধ অধিকার ছিল। ৭০-এর নির্বাচনে বাংলার জনগণ একমাত্র তাকেই এ ক্ষমতা দিয়েছিল। অন্য কেউ এ অধিকার অর্জন করেননি। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতেন। তিনি কোনো সময়ই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হতে চাননি বলেই শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছে একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ, বাঙালি জাতীয়তার একটি মহাকাব্য, একটি আন্দোলন, জাতি নির্মাণের কারিগর, ঠিকানা প্রদানের সংগ্রাম, একটি বিপ্লব, একটি অভ্যুত্থান, একটি ইতিহাস। বাঙালি জাতির ধ্রুবতারা, জাতির উত্থান, রাজনীতির কবি, জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতসহ অনেকেরই অবদান অবিস্মরণীয়। সেসময় ভারতের জনগণ ও সরকার, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী জনগণ, সরকার, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের সমর্থন এবং সহযোগিতার ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের সংগ্রাম বলীয়ান এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও অবদান আমরা কখনো ভুলতে পারি না। ভারতের জনগণ, সব রাজনৈতিক দল এবং সরকার আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে যেভাবে সামরিক সহায়তা প্রদান ও যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, এ ঋণ কোনো দিনই পরিশোধযোগ্য নয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার কারণে আমাদের সব প্রতিকূলতা দূর করে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদয় হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। ভারতের ভূমিকা এজন্য প্রশংসার দাবিদার। ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া এত তাড়াতাড়ি বিজয় অর্জিত হতো না। ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবনোৎসর্গ করেছে। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্রই রাষ্ট্র নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছে তার আইনগত ও রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণার বৈধ কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। এ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এ ঘোষণাপত্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে প্রজাতান্ত্রিক তা নিশ্চিত করে এবং বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত নেতা ও ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা সমর্থন ও অনুমোদন দেয়। এসবের বাইরে রাষ্ট্রটি কোনো দর্শনের ভিত্তিতে নির্মিত হবে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কোন দর্শনে পরিচালিত হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা ঘোষণাপত্রে রয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইংরেজিতে Proclamation of Independence-G বলা হয়েছে, In order to insure for the people of Bangladesh equality, humman dignity and social justice.
পরিশেষে বলা যায়, মুজিবনগর সরকারই বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক সরকার এবং এ সরকারের যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ সরকার সফলতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। এজন্য মুজিবনগর সরকার ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আমি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকলের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কার্যক্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কথা বলার পরিপূর্ণ ম্যান্ডেট তাদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এবং আইনগত দিক থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার গ্রহণযোগ্য
এখতিয়ার একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। যার কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতও এ ক্ষেত্রে যথার্থ রায় দিয়ে বলেছেন,
আইনানুগভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট