অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু


গোটা মার্চ জুড়েই ছিল অসহযোগ আন্দোলন। ৩ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। হানাদার সরকার তা বন্ধ করে দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতে হয়। ৩ তারিখ থেকে ওই আন্দোলন শুরু হয় এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত ওই আন্দোলন চলে। ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধু একচ্ছত্রভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধিবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে তালবাহানা শুরু করেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকেও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার ও বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেন। এজন্যই কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিষয়গুলো বুঝতে পেরে আলোচনার টেবিলে স্পষ্টত জানিয়ে দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না, তিনি চান বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। যেহেতু ৬ দফা ভিত্তিক ’৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাই তাকে ৬ দফার প্রশ্নে বাংলার জনগণ জয়যুক্ত করেছেন ও ৬ দফাকে তিনি নির্বাচনী ম্যান্ডেট বলে মনে করেন। তাই ৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপস করার অধিকার জনগণ তাকে দেননি।

এ কথা বলার পরপরই পাকিস্তান সরকার যুদ্ধের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করতে প্রস্তুত হলেন। পূর্ব বাংলায় তাদের ঘাঁটি আরো শক্তিশালী করার প্রয়োজনে সৈন্য ও গোলাবারুদ আনতে শুরু করেন। ঠিক এরূপ একটা দিনে মার্চের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিন কীভাবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে মোকাবিলা করবেন, তার পদ্ধতি তিনি ৭ মার্চের ভাষণে ব্যক্ত করেন। তার ওই ভাষণ শুনে, যেকোনো সচেতন বাঙালির মনে হয়েছিল, তিনি আজ শান্তিপূর্ণ কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা ভাবছেন না, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি হানাদার বাহিনী মোকাবিলা করবেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণ একদিকে ছিল রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ; অন্যদিকে ছিল সামরিক দিকনির্দেশনায় ভরপুর। ওই ভাষণের মাধ্যমে তিনি ২৩ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পরিহার করে সশস্ত্রভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার নির্দেশ দেন। তার ওই নির্দেশের পরপরই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

একদিকে হানাদার বাহিনী ছাত্র-শিক্ষক ও জনতার ওপর গুলি চালিয়ে অনেক বাঙালিকে হত্যা করে; অপরদিকে বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও অগণিত ছাত্র-জনতা বাংলাদেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। বেশ কয়েকটা জায়গায় মুক্তিবাহিনীর হাতে অনেক হানাদার সৈন্য নিহত হয়। আসলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এক গেরিলাযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। তিনি নির্দেশ দিলেন গ্রামে-গ্রামে প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলার, যার যা আছে, শত্রুর মোকাবিলা করবার। ঘোষণা দিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ্। বললেন, হানাদার বাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে অবরোধ করে দেওয়ার। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়ার। এমন অবরোধ করার নির্দেশ দিলেন যাতে হানাদার বাহিনীর সব সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি পাচকদের বলা হলো সামরিক বাহিনীর জন্য খাবার না রান্না করতে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অবরোধ। আরো বললেন, তিনি যদি নির্দেশ নাও দিতে পারেন, তাহলে জনগণ যেন গণযুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানের শেষ সৈন্যটাকে বিতাড়িত করে। আসলে তখন এমন একটা বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিা যে জনগণ প্রত্যাশা করেছিল ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু প্রাজ্ঞ শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন ওই ভাষণে তাৎক্ষণিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে হানাদার বাহিনী তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিহিত করে আক্রমণ চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করবে। তাই তিনি সুকৌশলে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বলে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি না উচ্চারণ করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।

আরেক অংশে তিনি বলেছেন, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব। এসব কথা বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। আপসের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তার ভাষণ এতই সুকৌশলী ছিল যে, হানাদার বাহিনী তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযোগ তুলে আক্রমণ চালাতে সক্ষম হলো না। ২৩ বছরের সংগ্রাম আন্দোলনে এভাবে বারবার কৌশল অবলম্বন করে তিনি প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তোলেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ও এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাহ আল্লাহ্। এসব ঘোষণা দেওয়ার পর ঘটা করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? ৭ মার্চের ভাষণ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ইচ্ছা জেগেছে বলেই কেউ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করতে পারতেন না। জিয়া বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা পুনঃ উল্লেখ করছেন মাত্র ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কারণেই হানাদার বাহিনী কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাছাড়া যিনি ২৬ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে যাত্রা করেছিলেন অর্থাৎ ২৬ মার্চ তার বোধদয় হয়নি যে, কোন পক্ষে যুদ্ধ করতে হবে। পাকিস্তান না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তাই ২৬ মার্চেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধৃত্ত হননি, তার পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা হয় কি করে, তাছাড়া প্রথমে জিয়া বলেছিলেন তিনি সরকার ও সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।

যখন প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ সরকার বা সামরিক বাহিনী কোনটাই তৈরি হয়নি। ওই রূপ ঘোষণা ছিল তখন জনগণের সঙ্গে এক মহা ধাপ্পা। তাই ৩ দশক ধরে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার অপসংগ্রামে যারা লিপ্ত; তারা জ্ঞান পাপী ছাড়া আর কিছুই নন। ৭ মার্চের ভাষণই বলে দেয় বঙ্গবন্ধুই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সর্বেসবা। স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালি জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার এ অবস্থানে আর কারো উন্নীত হওয়ার সুযোগ নেই।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

SUMMARY

433-1.jpg