একদিনে বা রাতারাতি শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে যাননি। অনেক ত্যাগ, অনেক নির্যাতন, অনেক জুলুম, দীর্ঘ দিন কারাভোগ, নানাবিধ নিপীড়ন, নির্যাতনকে বরণ করে, মানসিকভাবে সয়ে, জনপ্রিয়তা অর্জন করে তবেই শেখ মুজিব পেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব। শেখ মুজিবের চেয়ে বঙ্গবন্ধুতেই তিনি ছিলেন বেশী পরিচিত এবং জনপ্রিয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাধারণ ঘরের, অরাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন উদারপন্থী’, জনদরদী। মাত্র ৮ বছর বয়সেই তিনি নিজ গোলা থেকে ধান বের করে দান করেন গরীবদেরকে। শীতে নিজের গায়ের চাদর খুলে দান করতেন, ঘর থেকে টাকা চুরি করে অন্যের লেখাপড়ার খবর দিতেন। আকাশের মত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন।
এমন কীর্তি কলাপ দেখে অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে বড় হলে নামকরা কোন ব্যক্তি হবে। মাত্র বার বছর বয়সে সাধ হয় কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার। ঘুরে ঘুরে অবশেষে বিদ্রোহী কবিকে দেখেছিলেন। কবির স্লোগান ‘জয় বাংলা’ কে বঙ্গবন্ধু বুকের ভিতর লালন করেছিলেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু তিনি জানলেও অনেকই জানতনা এই জয় বাংলা স্লোগানই একদিন জাতীয় স্লোগানে রুপ নেবে এবং শক্তি যোগাবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে। সময়ের ব্যবধানে শৈশব, কৈশর পেরিয়ে যৌবনে এসে সিক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দি, শের-ই- বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাষানীর রাজনৈতিক আদর্শে। সাহসী, বীর এবং অসম্ভব দুরদর্শীতায় পরিপূর্ণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
নিজ যোগ্যতায় তিনি যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী সভায় মন্ত্রী হন। মাওলানা ভাষানী দিব্য জ্ঞানে দেখতে পেয়েছিলেন মুজিব হবে এ দেশের সবচেয়ে বড় নেতা, বাঙালির উদ্ধার কর্তা। তাইতো মাওলানা ভাষানী শেখ মুজবিকে আওয়ামী মুসলীম লীগের যুগ্ম আহবায়ক করে দেন। উল্লেখ্য শেখ মুজিব তখন ছিলেন কারাগারে। তিন নেতার আদর্শে শেখ মুজিবুর রহমান তিলে তিলে নিজেকে তৈরী করেন একজন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সময়ের ব্যবধানে পাকিস্তানী শাসকের বিমাতাসুলভ আচরণ এবং বৈরীতার প্রতিবাদ জানিয়ে শুরু করেন স্বাধীকারের আন্দোলন।
কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। পাকিস্তানী শাসক কখনই চাননি দেশে গনতন্ত্র কায়েম হোক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিড়াপিড়িতে অবশেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ নির্বাচন (৭ই ডিসেম্বর-১৯৭০) এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন (১৭ ই ডিসেম্বর-১৯৭০) দিতে বাধ্য হন। জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মোট ৬২৬ টি আসনের মধ্যে জয়লাভ করেন ৪৫৫ টি আসনে এবং বাকি ১৭১ টি আসন পায় ২১ দল মিলিয়ে। দল এবং ব্যক্তির প্রতি যদি সাধারণ ভোটারের বিশাল সমর্থন না থাকত তাহলে বঙ্গবন্ধু কি এককভাবে সংখ্যা গরিষ্টতা পেতেন? সংখ্যা গরিষ্টতার কারণে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান সম্মত হলেও তা দেওয়া হয়নি।
সেদিন থেকেই এ দেশের সাত কোটি মানুষ মনে প্রাণে জেনেছিল শেখ মুজিব তাদের নেতা এবং বাঙালি জাতির একমাত্র কান্ডারী। তাইতো ৭ই মার্চের আহবানকে বুকে লালন করে মহান নেতার আদেশকে মাথায় নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে স্বাধীন করতে এ দেশের আপামর জনতা। মাত্র একজন ব্যক্তি সাতকোটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার মত চেতনায় উদ্দিপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন অথচ সেই মহান নেতার দল করে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি মাত্র একটি জেলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। জাতির পিতার যত গুণাবলী এবং তাঁর যে মূল আদর্শ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ তা থেকে অনেকেই আজ বিচ্যুত। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন মহকুমা, জেলাতে দলের মধ্যে কোন বিভেদ সৃষ্টি করতে দেননি। দলকে কখনই একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হতে দেননি। কখনই বঙ্গবন্ধু কোন নেতা এবং কর্মীদেরকে সংঘাত ও গ্রুপিং করার সুয়োগ দেননি। তিনি কখনও পদের জন্য রাজনীতি করেন নি। তিনি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সমস্যার কথা শুনেছেন এবং কৌশলে কোন দ্বন্দ থাকলেও তা মিটিয়ে নিতে বলেছেন। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের অভ্যন্তরে কোন দ্বন্দ বা গ্রুপিং দলের মধ্যে ছিল না।। এটায় ছিল বঙ্গন্ধুর জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য, বড় স্বার্থকতা।
কিন্তু সেই আদর্শকে ধুলোয় মিশিয়ে নিজদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে প্রত্যেক জেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। কেউ কাউকে মানেনা, সম্মান করেনা। কনিষ্ঠ নেতা কর্মীরা কারো কথা শোনেনা। সকলেই যেন বেয়াড়া। নিজ দলের ভিতরে গ্রুপিং করে প্রতিনিয়ত চলছে মারামারি. হাতাহাতি অবশেষে খুন, জখম, জ্বালাও, পোড়াও ভাংচুর। হিংসা এবং বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেচে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কষ্ট। জাতির স্থপতি, মহানায়ক, কালের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতাকে রেখে যাওয়া আদর্শকে আজ দু’পায়ে মাড়িয়ে চলছে নিজেদের মত। বিভাজিত করে ফেলেছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু কি আসলেই বিভাজন তথা ভাগাভাগির পাত্র? কখনই নয়। যারা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে দলকে বহুধা বিভক্ত করে রেখেছেন তাদের কাছে প্রশ্ন ভাগের মায়ের কপালে কি মাটি জোটে? জোটেনা।
পার্টিকে বিভাজনের কারণে জাতীয় শোক দিবসের দিনে খুন করা হলো নিজেরই ভাইকে, নিজেদের কর্মী সবুজ কে। কুষ্টিয়ার সবুজ হত্যার মধ্য দিয়ে এটায় প্রমাণ হলো আমরা বঙ্গবন্ধুকে মানিনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করিনা। আরো প্রমাণ হয় জাতির পিতার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত নই। আমরা সকলেই যেন ব্যস্ত নিজেদেরকে জাহির করতে।
দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুকে রেখেছিলেন আড়াল করে। তাঁর নাম এবং অবদানকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পারেনি। বর্তমানে যা চলছে দলের ভিতর তাতে করে সাধারণ মানুষের মনে সহসা জন্ম নিতে পারে আওয়ামী লীগের প্রতি অনিহা। আমরা এর উত্তরণ চাই সহমর্মীতার মাধ্যমে। আমরা চাইনা দলকে বিভাজিত করণ। আগামী বছর সবুজের পরিবার কি পালন করবে জাতীয় শোক দিবস? সবুজের পরিবার পালন করবে আগামী বছর ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী। তারা কখনও পালন করবে না জাতীয় শোক দিবস। সবুজের পরিবার হয়ত অপপ্রচার করবে আগামীতে আওয়ামী লীগ ভাল না। এ কথা সঠিক নয়। ব্যক্তি চরিত্রের সাথে দলের আদর্শকে কখনই এক করা যাবে না। আমরা চাই দলীয় ব্যক্তিদের সহমর্মীতা এবং একত্রে দল করার প্রত্যয়। তবেই যদি বাস্তবায়িত হয় শতভাগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।