মাহমুদুল বাসার
শোকের মাস আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এ মাসের ১৫ তারিখে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। তাই আগস্ট মাসটি শোকের মাস হিসেবে পালন করে বাঙালি জাতি। যে বছর বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন, সেই বছরই অর্থাৎ ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও তা কোন সুষ্ঠু পরিণতিতে পৌঁছেনি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন এক পর্যায়ে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়, তার ফলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯১৯ সালে ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল ডায়ার জালিয়ান ওয়ালা বাগে যে বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়েছিলো, মহাত্মা গান্ধী তারই প্রেক্ষাপটে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রতিবাদে। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনকে একটি নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজনীতির মধ্যে একটি ধর্মীয় চেতনা কাজ করতো। অবশ্যই তা সাম্প্রদায়িক নয়। মওলানা আজাদও তো পরম, নিষ্ঠাবানে ধর্মবত্তা ছিলেন। তবুও মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতির মধ্যে রাম রাজত্বের পৌরাণিক ধারণা কাজ করতো। তাই তিনি রক্তপাত দেখে আন্দোলন থামিয়ে দিলেন। এর ২২ পর বছর তিনি ‘কুইট ইন্ডিয়া’-র ঘোষণা করেছিলেন। সে সম্পর্কে ড. মাজহারুল ইসলাম ‘গান্ধী মহারাজ’ নামে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন। ভারত মহাত্মা গান্ধীর কথা মতো, তার আদর্শের
ভিত্তিতে স্বাধীন হয়নি। মূলত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়েছে, স্বাধীনই হয়নি। ভারত ভাগের ভেতর দিয়ে জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব কায়েম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতির মূলেই প্রভেদ আছে। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ধর্মের কোন প্রভাব কাজ করতো না। কাজ করতো জাতীয়তাবাদী চেতনা। ইংরেজ আমলেই তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনি মোকাবিলা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী, সামরিক এক নায়ক, সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ দোসর ও ফ্যাসিবাদী শাসকদের। মহাত্মা গান্ধী মোকাবেলা করেছিলেন ইংরেজ ধুরন্ধর শাসকদের একই সঙ্গে জিন্নাহর মুসলিম লীগকে। অহিংস পন্থা ছিল তাঁর প্রধান অস্ত্র। তার মধ্যে কাজ করেছে সর্বভারতীয় রাজনীতি। জিন্নাহর ছিলো পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি। ভারতকে দ্বি-খন্ডিত করার যে টার্গেট জিন্নাহর ছিলো তা তিনি সফল ভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। কেউ রোধ করতে পারেনি। জিন্নাহ পাকিস্তান চেয়েছিলেন, সেটা তিনি প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী যা মূলত করতে চেয়েছিলন, তা তিনি পারেনি। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আর জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘ডিভাইড এ্যান্ড কুইট’ জিন্নাহর কথাই কার্যকর হয়েছে। ভারত দ্বি-খন্ডিত হওয়ার অর্থই জিন্নাহর বিজয় আর মহাত্মা গান্ধীর পরাজয় এক অর্থে। মহাত্মা গান্ধীর মহত্ত্ব আর বিরাটত্ত্ব অন্য জায়গায়। সেটা ভিন্ন কথা। রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর এক চেটিয়া সাফল্য নেই। তাঁর কোনো পরিকল্পনা মোতাবেক ভারত ভাগ হয়নি। ভারত ভাগের নায়ক জিন্নাহ আর নেহেরু। বঙ্গবন্ধুর বেলায় এই ইতিহাস প্রযোজ্য নয়। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে দেখা যায় তিনিও পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি পাকিস্তান চেয়েছিলেন তাই বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তান আন্দোলনে নিবেদিত ছিলেন। আবার এটাও দেখা যায় যে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলা চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁরও সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান হয়ে গেলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালিদের ভোটে। বাঙালিরা ভোট দিয়েছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের আহবানে। ১৯৪৬ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্মী হিসেবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই ব্ংালা ভাষার মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখনই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভেতরে যে স্বপ্ন বাঙালিরা দেখেছিলেন, তা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙার আন্দোলন, এই আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী নন, একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান। নাম এ্যালান অক্টোভিয়ান। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা, আওয়ামী লীগেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কংগ্রেস মূলতই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। আর আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধু একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। জিন্নাহ মুসলমানদের নেতা, মহাত্মা গান্ধী হিন্দুদের নেতা আর বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের নেতা। বঙ্গবন্ধু একটি সেকুলার স্টেটের প্রতিষ্ঠাতা। সেকুলার না হলে বাঙালি হওয়া যায় না। ভারত ভাগের পূর্বে যে রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়েছে, মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, অগণিত নর নারী জীবন হারিয়েছেন। এ সব ইতিহাসের কলঙ্কিত ঘটনা। এর দায় মহাত্মা গান্ধী, জিন্নাহ আর নেহেরুর ওপর বর্তায়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তাতে তাঁর আহবানে প্রতিটি বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তারা জীবন বাজি রেখে, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে ফেলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ১ হাজার মাইল দূরে ছিলেন, তবুও তাঁর প্রভাব, তাঁর ভাষণ এবং তাঁর নির্দেশ মোতাবেক দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ভারত ভাগের ঘটনাটি অগৌরবের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ঘটনা, ত্যাগের এবং গৌরবের। ভারত ভাগের সময় মহাত্মাজীর কোন নির্দেশই কার্যকর হয়নি। কোনো নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে ছিলো না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জিন্নাহ আর নেহেরু-প্যাটেলের হাতে। মওলানা আজাদ বলেছেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী হয়ে দাঁড়ালেন দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রধান সমর্থক।’ কোনো উপায় ছিলো না তার, তিনি ছিলেন অসহায়। তাই তিনি রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে না থেকে চলে গিয়েছিলেন প্রার্থনা সভায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তাঁর লক্ষ্য বিন্দুতে অনিরুদ্ধ গতিতে চলে গিয়েছিলেন। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথাটি অমোঘ সত্য। জিন্নাহর ১৪ দফা ১ দফায় এবং শেখ মুজিবুরের ৬ দফা ১ দফায় পরিণত হয়েছে। জিন্নাহ চেয়েছিলেন পাকিস্তান, সেটা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশে সেটাও হয়েছে। পার্থক্য এখানে যে, পাকিস্তান অস্ত্রের জোরে টিকেছিলো ২৩ বছর, আর বাংলাদেশের বয়স ৪৬ বছর পার হতে চলেছে। শৈলেশ দে’র ‘আমি সুভাষ বলছি’ বইতে পেয়েছি, মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৭ সালের দিকে বলেছিলেন, ‘সবাই আমাকে বাপুজি বলে, কিন্তু কেউ আমার কথা শোনে না।’ এমন কথা বঙ্গবন্ধুর বেলায় প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুসারে তাঁর নেতৃত্ব মোতাবেক। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক। তাঁকে সুপারসিট করার ক্ষমতা কারোরই ছিলো না। তিনি ৬ দফা দিয়েছিলেন পাকিস্তান ভাঙার অস্ত্র হিসেবে, তিনি ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’। ঠিক তাই হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি যা যা বলেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিদ্র ঐক্যে আবদ্ধ করেছিলেন। অস্ত্র ধরার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন। ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, শেখ মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের সময় ৩৫ টি নির্দেশ জারি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী এভাবে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি ভারত ভাগের স্বপ্ন দেখেননি, দেখেছিলেন অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন কিন্তু তা হয়নি। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, পরিকল্পনা প্রণয়নকারী, এবং তা বাস্তবায়নকারী। তিনি স্বাধীনতার স্থপতি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মিল এখানেই যে, মহাত্মাজী গোটা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, কংগ্রেসকে জনপ্রিয় করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনো দল করেননি, বঙ্গবন্ধুও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল করেননি। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিলো হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের সমর্থক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয় প্রার্থনা সভায় আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় জুমার দিন শুক্রবার, ফজরের নামাজের সময়। পার্থক্য এখানে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয় একরাতে। মহাত্মা গান্ধী প্রার্থনা সভায় জীবন দিয়েছেন একাই, তাঁর পরিবারের কেউ জীবন দেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা অনেক বেশি। মহাত্মা গান্ধী হত্যার পর ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয়নি, সংবিধানের পরিবর্তন ঘটেনি। যে অশুভ শক্তির পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিলো, সেই হিন্দু উগ্রপন্থিরা ক্ষমতা দখল করতে পারেনি বরং সমগ্র ভারত থেকে তথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মহাত্মার হত্যাকারীর বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছিলো। সমালোচিত হয়েছিলেন বল্লবভাই পাটেল, কারণ তখন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায়। পরিবর্তন হওয়া বাকি ছিলো রাষ্ট্রের পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যাকে শিখন্ডী করে নিধনযজ্ঞটি চালান, তিনি রক্তের সিঁড়ি পথ বেয়ে ক্ষমতায় চলে আসেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মহান মুক্তিযুদ্ধের মান্ডেট পদ-দলিত করেন। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংসের সাধক আর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ‘শান্তির দূত’ খেতাব পেয়েছিলেন বিশ্বসংস্থার পক্ষ থেকে।