বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর


মাহমুদুল বাসার 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানম-ি ৩২ নম্মর সড়কের বাস ভবনে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা-ে হত্যাকারীদের কৃতকর্মের সাথে জড়িত ছিলো রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যর্থতার একটি বড় ভূমিকা যা সেদিন জাতির পিতার হত্যাকা-কে সহজ করে দিয়েছিলো হত্যাকারীদের জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঘটনাচক্র এবং সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যর্থতার দালিলিক প্রমাণ সহ কোনো কোনো গবেষক ইতোমধ্যে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। 
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষে প্রমাণ হয়েছে, ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি প্রথম দফা আক্রান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর যে সদস্যদের দেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল স্বস্তি আর নিশ্চিত বোধ করছিলেন, তারাই প্রথম তাঁকে এবং এর পর একে একে অন্যদের হত্যা করেছে। মামলার বাদী এবং এক নম্বর সাক্ষী মুহিতুল ইসলামের সাক্ষে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, প্রথম হামলার পরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর নিরাপত্তায় ৩২ নম্বরে অবস্থান করা নিরাপত্তা কর্মীরা কেই কিছু করছে না। ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করো?’ বলে বিরক্তও প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। 
মুহিতুল ইসলাম বলেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে দোতলা থেকে নিচে নেমে সেনা সদর, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং গণভবনে টেলিফোন করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই এক ঝাঁক গুলি দক্ষিণ দিকের জানালার কাঁচ ভেঙে নিচতলার অফিস কক্ষের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিনকে টেলিফোনে পেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই গুলিতে জানালার কাঁচ ভেঙে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ে গুলি লেগে রক্ত ঝরতে থাকে। সে সময় বঙ্গবন্ধু এত গুলি কিসের? জানতে চাইলে একজন সেন্ট্রি বাইরে থেকে হামলার কথা জানান। 
ডিএসবির প্রটেকশন ফোর্সের সদস্য হিসেবে তখনকার হাউস গার্ডের দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম খান সেন্ট্রিদের কাউন্টার ফায়ারিংয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বললেও নিরাপত্তা কর্মীদের কেউ সেটা করে নি। সে সময় কালো এবং খাকি পোশাকধারী কিছু সেনা সদস্য ‘পূর্বদক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিম‘ দিক থেকে ক্রলিং করে বাড়ির দিকে আসছে দেখে বঙ্গবন্ধু দোতালায় চলে যান। এরপরই শেখ কামাল নিচে নেমে এসে নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর্মি কি এসেছে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘ মনে হয় এসেছে।’ এর আগেই বঙ্গবন্ধু তাঁর শয়নকক্ষে টেলিফোনে সেনাপ্র্রধান এবং বিদায়ী প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। তাই শেখ কামাল খুশি হয়ে বলেন, ‘আর্মি ভাইয়েরা কারা এসেছেন ভেতরে আসেন। ২য় বারও একই কথা উচ্চারণ করেন। কিছুক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ ছিলো না। পরে হঠাৎ ৫/৬ জন ক্ালো ও খাকি পোশাকধারী আর্মি গেট ধাক্কা দিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। কিছু দূর এগিয়ে তারা ‘হ্যান্ডস আপ’-এর নির্দেশ দিলে নুরুল ইসলাম খান এবং এক পুলিশ সার্জেন্ট ‘হ্যান্ডস আপ’ করেন। শেখ কামাল কিছুটা আশ্চর্য হয়ে হাত উঠিয়ে বলেন, ‘আমি শেখের ছেলে কামাল।’ তারা দ্বিতীয়বার ‘হ্যান্ডস আপ‘ বললে হ্যান্ডস আপ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা শেখ কামালকে গুলি করে। কামালকে বজলুল হুদা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের কাছে নিয়মিত আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তাদের কাছে কোনো গুলি ছিলো না। প্রথম দফা আক্রমণের আগেই তাদের কাছ থেকে ইউনিটের সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ার্দার সব গুলি নিয়ে যায়। এই সুবেদার মেজরকে হত্যাকা-ের পর পর র‌্যাংক ব্যাজ পরিয়ে লেফটেন্যান্ট হিসেবে ঘোষণা করে খুনী ফারুক। সে সময়ের ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির যে ইউনিটটি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো, তাদের সাক্ষ্যে আবদুল ওহাব জোয়ার্দারের গুলি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এসেছে। তাদের একজন প্রসিকিউশনের ৫ নম্বর সাক্ষী সুবেদার গনি। তিনি জানান, ১৫ আগস্টে ভোর আনুমানিক সোয়া ৪ টার দিকে তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দার এসে গার্ড পরীক্ষা করেন। তারপর তিনি বলেন, ‘তোমাদের পুরাতন গুলি দিয়ে দাও, আমি নতুন গুলি দিচ্ছি।’ গুলি নিয়ে জোয়ার্দার জিপে উঠে চলে যায় কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীদের নতুন কোনো গুলি দেওয়া হয় নি। এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের কারণে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের নিরাপত্তা রক্ষীরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন নি। এর ফলে একজন নিহত হন, আহত হন কয়েকজন। বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলের সঙ্গে শহীদ হন সিপাহী শামসু। বড় দুর্ভাগ্য, ঘৃণ্য আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দার মামলার রায়ে খালাস পায়। 
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ভবন কোনো প্রাসাদ বা দুর্গ না হলেও একাধিক খুনী ঐতিহাসিক ছোট ওই বাড়িটিতে আগে একাধিকবার গিয়ে থাকলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সর্বশেষ অবস্থা দেখতে ১৪ আগস্ট বিকেলে কমপক্ষে দুই খুনী রেকি করে এসেছিলো। তাদের একজন মেজর ডালিম। আরেকজন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। সেখানে তাদের উপস্থিতি এবং মোটর বাইকে একাধিকবার চক্কর দেয়াটা অস্বাভাবিক হলেও কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করেননি। কোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনেনি। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেজর ডালিম যে অপরাধ করেছিলো তাতে শুধু পদচ্যুতিই যথেষ্ঠ ছিলো না। একই কথা খাটে আরেক খুনী মেজর নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। অপরাধের মাত্রা হিসেবে ্ওই দু’জন সহ আরো কয়েকজনের চাকুরিচ্যুতির পাশাপাশি কারাগারেই থাকার কথা ছিলো। কিন্তু সেটা হয় নি। আর সে কারণেই তারা ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকা- ঘটাতে পেরেছিলো। 
বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র ছিলো নিখুঁত। ব্যর্থতা ছিলো সেনা প্রধানের। বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন সেনা উপপ্রধান। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা কম ছিলো না। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। তাঁকে হারিয়ে বাংলাদেশ সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আকণ্ঠ সমস্যার গহবরে নিপতিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান করেছিলেন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো দ্রুত করে ফেলেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে এত কাজ তিনি করেছিলেন যে, তার একটি দিক নিয়ে বলতে গেলে মহাপুস্তক হবে। বঙ্গবন্ধু যদি সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব না দিতেন, কবে কখন কারা সংবিধান প্রণয়ন করতো কে জানে? সংবিধানবিহীন একটি দেশের মর্যাদা কী? ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে দিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমরা সেটা কাজে লাগাতে পারিনি। শিক্ষনীতি হবে গণমুখী, ধর্মনিরপেক্ষ; এ কথা বঙ্গবন্ধুর। প্রাইমারি শিক্ষা জাতীয়করণ করলেন, শিশুদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দিলেন। বাংলা ভাষাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিলেন। বললেন, ‘ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিলেন। ‘জুলিও কুরি‘ উপাধি পেলেন। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করে, সেখানে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে পুনর্গঠন করলেন। এক কোটি শরণার্থী পুনর্বাসন করলেন। 
তাঁকে যখন হত্যা করা হয় তখন দেশের অবস্থা স্থিতিশীল ছিলো। জিনিসপত্রের দাম কম ছিলো। দেশে ফসলের ফলন ভালো হয়েছিলো। আইনশৃঙ্খলা তিনি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি খাত সমৃদ্ধ করেছিলেন। সবচেয়ে বড়কথা তিনি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে জনগণের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁকে হত্যা করা হয়। 
তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশকে ১৯৪৭ সালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান ছিলো একটি অপরাষ্ট্র, আজো তাই আছে। বাংলাদেশকেও পাকিস্তান বানানো হয়েছিলো। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে যে ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক, মানবিক, শাশ্বত চেতনার বৃক্ষ রোপন করেছিলো তা সমূলে উৎপাটন করা হয়। এদেশে রাজাকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। সামরিক আমলে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব বলেছেন, ‘গাদ্দাররা পাকিস্তান ভেঙেছে।’ 
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকেই যাত্রা শুরু করেছিলো। তাই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সূচকে উন্নয়ন ঘটেনি। জিয়ার আমলে উত্তর বঙ্গে মঙ্গা হয়েছিলো। মা-বোনেরা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দলে দলে বেশ্যার খাতায় নাম লিখিয়েছে, এ খবর পত্রিকায় পড়েছি। অসৎ পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, আমলাদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে, দেশের ধনসম্পদ রাজাকাররা এবং দেশবিরোধী ধনিকরা লুণ্ঠন করেছে। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো। রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে দল গঠন করেছেন জিয়া-এরশাদ। গণতন্ত্রের খোলোস ছিলো কিন্তু যথার্থ গণতন্ত্র ছিলো না বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। জাতীয় সংসদ রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়েছিলো। সব ক্ষমতা ছিলো সামরিক অধিনায়কের পকেটে। 
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে মাত্র এক দশকের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারতেন। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অভিমান করে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করার পর বঙ্গবন্ধু কোনো দলীয় লোককে নয়, বিশিষ্ট বিদ্বান ড. এ,আরা, মল্লিককে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধু দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারতেন। লিক্যুয়ান ও মাহাথীর মোহাম্মদের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত যোগ্যতা বেশি ছাড়া কম ছিলো না। তিনিই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে পারতেন। আমাদের ২০১৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।

SUMMARY

422-1.jpg