ডেভিড ফ্রস্ট একজন স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কয়েকদিন পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই সাক্ষাৎকারটি তিনি নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি কখনও বঙ্গবন্ধুর অফিসে, কখনও তাঁর বিখ্যাত সেই ছোট্ট নীল সরকারি গাড়িতে, কখনও ৩২ নাম্বার বাড়ির শোবার ঘরে, বারান্দায় বসে নেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারেই দেশবাসীর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার বিষয়টি। সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হওয়ার পর বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।
ডেভিড ফ্রস্ট: যে রাতে আপনি গ্রেফতার হয়েছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন আপনি গ্রেফতার হতে পারেন। এ ছাড়া পাক সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে এ ধরনের সংবাদও আপনি টেলিফোনে পেয়েছিলেন; তা সত্ত্বেও আপনি গ্রেফতার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন কেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেই ওরা আমাকে হত্যা করত এবং বলত, শেখ মুজিব চরমপন্থিদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমি নিহত হওয়ার পর ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে বলত, তারা শেখ মুজিবের সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য আলাপ আলোচনা করছিল কিন্তু চরমপন্থীরা তাকে হত্যা করেছে। এবং তারা আমার হত্যার প্রতিশোধের নামে আমার জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারা একটা তাণ্ডব অবস্থার সৃষ্টি করত। এটাই ছিল তাদের প্রথম মতলব। আমি জানি তারা অসভ্য, তারা পশু। আর এ জন্যই আমি চিন্তা করেছিলাম আমার মৃত্যুই শ্রেয়, তবু আমার জনগণ বেঁচে থাকুক। তারা আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি অন্তত কলকাতায় যেতে পারতেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আমি যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমি আমার জনগণকে ফেলে কীভাবে যাই? আমি আমার জাতির নেতা। আমি তাদের জন্য যুদ্ধ করতে পারি, মরতে পারি, যেহেতু আমিই তাদেরকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলেছি।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক। কারণ বিগত নয় মাসে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনি একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। এখন তারা আপনাকে একজন ঈশ্বরই মনে করে।
শেখ মুজিবুর রহমান: আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবাসি এবং তাদের রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। বন্য পশুরা আমাকে গ্রেফতার করে এবং আমার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে। এমনকি তারা আমার গ্রামের বাড়িও ধ্বংস করে। সেখানে আমার ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধ মাতা বাস করতেন। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদেরই চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন দেয়।
অবশ্য আমি মনে করেছিলাম, যদি তারা আমাকে পায় তাহলে আর আমার নিরীহ জনগণকে হত্যা করবে না। আমি জানতাম, আমার পার্টি যথেষ্ট শক্তিশালী। আমি একটি শক্তিশালী পার্টি সংগঠিত করেছি এবং এর পেছনে রয়েছে বিপুল জন সমর্থন। আমি জানি তারা যুদ্ধ করবে। তাদের প্রতি আমার নির্দেশ ছিল, আমি থাকি আর না থাকি, যতক্ষণ না পর্যন্ত মুক্তি অর্জিত হবে তোমরা প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনাকে ওরা ঠিক কীভাবে গ্রেফতার করেছিল? তারা কি আপনাকে রাত ১.৩০ মিনিটে গ্রেফতার করেছিল? তখন কী ঘটেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা প্রথমেই আমার বাড়িতে মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।
ডেভিড ফ্রস্ট: ওরা যখন এলো, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: আমি আমার শোবার ঘরেই ছিলাম। এটা আমার শোবার ঘর। এদিক দিয়েই ওরা প্রথম গুলি ছুড়তে শুরু করে। আর এই দিক দিয়ে তারা জানালায় গুলি ছুড়তে শুরু করে।
ডেভিড ফ্রস্ট: এগুলো সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, সবই ধ্বংস করেছিল। আমার পরিবার আমার সঙ্গে ছিল। একটা গুলি সরাসরি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছয় বছরের ছেলেটি এই বিছানায় শুয়ে ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তান নিয়ে বসেছিলেন।
ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢুকেই কী শুরু করেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: তারা চারপাশের জানালা দিয়ে গুলি করা শুরু করে। সে সময় আমি আমার স্ত্রীকে এবং দুই সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে বাইরে চলে আসি।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার স্ত্রী কিছু বলেননি?
শেখ মুজিবুর রহমান: না, সে কোনো কথা বলেনি। আমি শুধু তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দরজা খুলে বাইরে এসেই আমি বলি, ‘গুলি বন্ধ করো। তোমরা চিৎকার করছো কেন? আমি তো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।’ তখন সৈন্যরা চারপাশ থেকে আমার দিকে ছুটে এলো, বেয়নেট চার্জ করার জন্য। কিন্তু একজন অফিসার দ্রুত আমাকে ধরে ফেলে বলে, ‘একে মের না।’
ডেভিড ফ্রস্ট: শুধু একজন অফিসারই তাদের থামিয়ে দেয়?
শেখ মুজিবুর রহমান: একজন অফিসারই থামিয়ে দেয়। তারপর তারা আমাকে টেনে হিচড়ে নিতে শুরু করে। যদিও একজন অফিসার আমাকে ধরেছিল। তবুও তারা চারপাশ দিয়ে রাইফেলের কুঁদো ও বুট দিয়ে আমাকে গুঁতাতে থাকে। আমি তাদের বলি, তোমরা আমাকে নিয়ে টানা হেচড়া করছ কেন? আমাকে আমার পাইপ ও প্রয়োজনীয় তামাক নিয়ে আসতে দাও অথবা আমার স্ত্রীকে দিয়ে যেতে দাও। আমি সেগুলো নেবার জন্য এসে দেখি আমার স্ত্রী পাইপ এবং একটি ছোট সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে তখন আগুন জ্বলছিল।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি যখন এই ৩২ নাম্বার বাড়ি থেকে সেদিন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনো দিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: না, আমি ভেবেছি এটাই আমার শেষ। তবে আমার সান্ত্বনা ছিল, আমি আমার জাতির সম্মান রক্ষা করতে পেরেছি। আমার জাতি পৃথিবীর বুকে মুখ দেখাতে পারবে। আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি। তাদের নেতা হিসেবে আমি মাথা উঁচু করে মরেছি।
ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তানি সেনারা কি আপনার বাড়ির সবকিছু লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়-সবকিছুই লুণ্ঠিত হয়েছে। মি. ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুঠ করেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান: সবই পাকিস্তানি সৈন্যরা নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আমার আসবাবপত্র, ছেলেমেয়েদের কাপড়-চোপড় নিয়েছিল তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার গত ৩৫ বছরের রাজনৈতিক ডায়েরিটা নিয়েছে। এ ছাড়া আমার একটি লাইব্রেরি ছিল। তারা সেখান থেকে সব বই নিয়েছে। সেখানে কিছু মূল্যবান দলিলপত্র ছিল তাও নিয়েছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: আবার প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। কেন তারা এমন করল?
শেখ মুজিবুর রহমান: জানি না। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রকৃত অর্থে মানুষ নয়। বাস্তবিক তারা বন্য, বর্বর। আমার বাড়ির কথা বাদ দিন, তারা অন্য ক্ষেত্রে কী করেছে- এগুলো একটু ভেবে দেখুন। ২ বছরের দুগ্ধপোষ্য শিশু, ৫ বছরের নিষ্পাপ শিশুকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেওয়া, পোড়াবাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব, না-খাওয়া মানুষ সব বাস করতো ওই বস্তিতে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের ওপর চারিদিক থেকে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: পাকিস্তানে বন্দী থাকাকালে আপনার বিচারের নামে কী ঘটেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক অফিসার, আর বাকি কয়েকজন ছিল বেসামরিক অফিসার।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনলো ওরা?
শেখ মুজিবুর রহমান: রাষ্ট্রদ্রোহ, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচারণ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র- এমনি সব আরকি। সব মিলিয়ে বারোটার মতো অভিযোগ ছিল, এর যে কোনো ছয়টা অভিযোগের প্রত্যেকটিরই শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় ছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় একজন আইনজীবী দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম অবস্থাটা এমনি যে, যুক্তির কোনো দাম নেই। এ হচ্ছে বিচারের নামে প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মি. বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবকে যেতে বলুন। কারণ এটা বিচার নয়, এটা একটা ক্যামেরা মহড়া মাত্র। আমি বেসামরিক লোক, কোনো মতেই আমার কোর্ট মার্শাল হতে পারে না। তাছাড়া ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও। তিনিই এই বিচারালয়ের দন্ডমুন্ডের কর্তা।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি কি মনে করেন, ইয়াহিয়া খানই বিচার শেষে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ। তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
ডেভিড ফ্রস্ট: তারা কি বিচার শেষ করে, সরকারিভাবে কোনো রায় তৈরি করেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সব বিচারককে রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান রায় তৈরি করার জন্য। বিচারক মানে ঐ সকল কর্ণেল ও ব্রিগেডিয়ার। তিনি তাদের বিচারের রায় জানিয়ে দেন। এবং সেখানেই তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
ডেভিড ফ্রস্ট: আমি বিশ্বাস করি, বাস্তবিকই আপনি দেখেছিলেন যে জেলের পাশেই আপনার কবর খোড়া হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান: অবশ্যই। আমি নিজেই দেখেছি- আমার সেলের পাশে ওরা কবর খুড়েছিল।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি কি জানতেন তারা কী করছে?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম ওরা কবর খুড়ছে। এমনকি আমি বলেছি সম্ভবত এটা আমার কবর- ভয় নেই, আমি তৈরি আছি।
ডেভিড ফ্রস্ট: ওরা কি আপনাকে কখনও বলেছিল, এটা আপনার কবর?
শেখ মুজিবুর রহমান: না, ওরা তা কখনও বলেনি।
ডেভিড ফ্রস্ট: কি বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিবুর রহমান: তারা বলত না, না, যদি বোম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে শেল্টার নিতে পারবে- সে ব্যবস্থাই করছি।
ডেভিড ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা?
শেখ মুজিবুর রহমান: আমার প্রথম চিন্তা ছিল আমার দেশ, তারপর আমার পরিবার। আমি আমার জনগণকেই বেশি ভালোবাসি। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কি গভীরভাবে ভালোবাসে।
ডেভিড ফ্রস্ট: কে আপনাকে কবর থেকে রক্ষা করেছিল সেদিন?
শেখ মুজিবুর রহমান: আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ডেভিড ফ্রস্ট: আমি একটা সংবাদ মাধ্যমে পড়েছি যে, ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করে সে সময় জেলার নাকি আপনাকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছিল। এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিবুর রহমান: ওরা জেলাখানায় এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছিল, মনে হচ্ছিল কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল। যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তো-বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময় সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে মরু অঞ্চলের কোনো একটা কলোনিতে চার, পাঁচ অথবা ছয়দিনের মতো লুকিয়ে রাখল। এই সময় আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার ছাড়া আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ডেভিড ফ্রস্ট: হায়! ঐ অফিসারদের কপালে কী ঘটেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: আমি জানি না। তবে তাদের কপালে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো দুর্ভোগ জুটেছিল। ওদের জন্য যথার্থ শুভ কামনা রয়েছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, সে সময়ও নাকি সে আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য ভুট্টোকে সুপারিশ করেছিলেন- এটা কি সঠিক?
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, এমন একটা রসাত্মক গল্প মি. ভুট্টোই আমাকে বলেছেন। ইয়াহিয়া খান তাকে বলেছিলেন, ‘মি. ভুট্টো সাহেব, আমি ঐ বড় শয়তান মুজিবকে হত্যা করে যেতে পারলাম না।’
ডেভিড ফ্রস্ট: সে এমন বলেছিল!
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ। সে ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিল আমার ফাঁসিটা অন্তত কার্যকরী করার জন্য। কিন্তু ভুট্টো এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
ডেভিড ফ্রস্ট: ভুট্টো সাহেব আপনাকে কী বলেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন- ‘না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দী রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মি. ইয়াহিয়া এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটা লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ভুট্টো যথার্থই চিন্তা করেছিলেন। ঘটনা যে এদিকে গড়াতো তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
ডেভিড ফ্রস্ট: এ মুহূর্তে যদি আপনি ইয়াহিয়া খানের মুখোমুখি হন, আপনি তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: সে একটা জঘন্য অপরাধী। সে তার সেনাবাহিনী দিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। আমি তার ছবি দেখতেও রাজি নই।
ডেভিড ফ্রস্ট: মি. ভুট্টো তাকে গৃহবন্দী করেছে। তার প্রতি মি. ভুট্টোর কী করা উচিত বলে মনে করেন?
শেখ মুজিবুর রহমান: আপনি জানেন, বাংলাদেশে কী ঘটেছে? আমি আপনাকে বলছি, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিশু, স্ত্রীলোক, কৃষক, শ্রমিক সব মিলিয়ে কমপক্ষে তারা ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে। কমপক্ষে ২৫-৩০ ভাগ ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে। এমনকি সমস্ত খাদ্য গুদামগুলোও তারা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: কেমন করে আপনি জানেন, মৃতের সংখ্যা ৩০ লাখ?
শেখ মুজিবুর রহমান: আমার পৌঁছানোর পূর্বেই আমার জনগণ এ তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। সর্বত্রই শিকড় পর্যায়ে আমার সংগঠন আছে, সে সব স্থান থেকে আমি সংবাদ পাচ্ছি। আমরা এখনও চূড়ান্তভাবে হিসাব করিনি। তবে এর সংখ্যা ত্রিশ লাখের বেশি হবে, মোটেই কম হবে না।
ডেভিড ফ্রস্ট: এটা কি মুসলমানের হাতে মুসলমান হত্যা নয়?
শেখ মুজিবুর রহমান: তারা কেবলমাত্র মুসলমানের বুলি আওড়ায়। কেমন করে একজন মুসলমান মুসলিম বালিকাকে হত্যা করে। এ ছাড়া আমরা হাজার হাজার মেয়েকে উদ্ধার করেছি। নির্যাতিত মেয়েদের অনেককে উদ্ধার করেছি। এদের স্বামী, পিতা-মাতা সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়ের শ্লীলতা নষ্ট করেছে। পুত্রের সামনে মার শ্লীলতা নষ্ট করেছে। আপনিই চিন্তা করুন, এরপর তারা কেমন করে নিজেদের মুসলমান হিসেবে দাবি করে? আমি এ কথা চিন্তা করে অশ্রু রোধ করতে পারি না। বাস্তবিক তারা তো পশুরও অধম।
আমার বন্ধু এবং আমার পার্টির একজন প্রথম সারির নেতা মি. মশিউর রহমান (তিনি কেঁদে ফেলেন) এমনকি তিনি বাংলাদেশের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী, তিনি নির্যাতিত ও নিহত হয়েছেন। তারা তাকে ২৪ দিন ধরে নির্যাতন করেছে। প্রথমে তারা তার ডান হাত কেটেছে, এরপর বামহাত এরপর কান, পা এভাবে ২৪ দিন ধরে নির্যাতন করে তবেই তাকে হত্যা করে। এটা অনেক ঘটনার একটি মাত্র। আমাদের নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারীদের জেলখানায় আটক করে; সেখান নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে তারপর হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনি আমি ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ডেভিড ফ্রস্ট: তারা কিসের আশায় এ কাজ করেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান: তারা এ দেশকে একটা কলোনি করতে চেয়েছিল। আপনি জানেন, ওরা বাঙালি পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র- সবাইকে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট: তারা কি যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এই ঢাকাতেই ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে?
শেখ মুজিবুর রহমান: শুধুমাত্র এই ঢাকায় আত্মসমপর্ণের একদিন পূর্বে তারা ঐ কাজ করে। এবং ১৫০ জন নয়, তিনশ জন বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করে। তারা সকলেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ সকল বুদ্ধিজীবীরা তাদের বাড়িতেই নিহত হয়েছেন।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
তথ্যসূত্র:
১. একাত্তরে বিশ্বে বঙ্গবন্ধু, স্বদেশ রায়, পল্লব পাবলিশার্স
২. বিভিন্ন ওয়েবসাইট