বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় চেতনা


অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহাকালের মহানায়ক, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন নেতা ছিলেন যাঁর সব বিষয়েই সু-দৃষ্টি ছিল। ছোট-বড় যে কোনো বিষয়কে তিনি সজাগ চোখে দেখতেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিতে তাঁর যেমন অগাধ জ্ঞান ছিল, তেমনি ধর্ম নিয়েও তাঁর পড়াশোনা ছিল সমীহ করার মতো। এ দেশের সকল ধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর শাসনামলে বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা অক্ষুণœ ছিল। পাকিস্তানি মৌলবাদী চেতনা যেন মাথাচাড়া না দিয়ে উঠে, সেদিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল।
বঙ্গবন্ধু চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ হলেও তিনি ভুলে যাননি এ দেশের বেশিরভাগ লোক মুসলমান। তাই ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেন। একই বছরের ২৮ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন তৈরি হয়। তিনি কেবল ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাই করেননি, এর জন্য যথাযথ স্থানও বরাদ্দ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ইসলামের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মর্মবাণী মানুষের কাছে পৌঁছাতে অর্থবহ ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পুনঃনির্মাণ করেন। আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থা ওআইসিতে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর আন্তরিকতায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে তিনি ওআইসি সম্মেলনে পাঠান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ধর্মভীরুদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। বলা হয়েছিল এই যুদ্ধ ইসলামবিরোধী যুদ্ধ। যারা এ যুদ্ধ করছে তারা ইসলাম মানে না, তাদের ঈমান নেই। ইসলামের নামে স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হলো। গনিমতের মাল হিসেবে লুটপাট করা হলো তাদের সম্পত্তি। ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে হানাদাররা এদেশের মানুষকেই নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরও পাকিস্তানের সেসব প্রেতাত্মা জীবিত ছিল, তারা যেন ইসলামের অপব্যাখ্যা করার সুযোগ না পায় সে লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যাতে কারো ক্ষতি না করতে পারে এবং এক ধর্মের মানুষ যেন অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, প্রত্যেকে যেন স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে সেদিকে গুরুত্বারোপ করেন। জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। অন্য সম্প্রদায় তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে, যে কথাটি ইসলামেও স্বীকৃত। তিনি আরও বলেন- ‘এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।’ এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুটপাট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না।’ বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলাদেশ চেয়েছেন তাতে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িকতার স্থান ছিল না। তিনি চেয়েছেন কেউ যাতে কারো ধর্ম অবমাননা না করেন। ইসলাম ধর্মে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করার কথা বলা আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ইসলামের সেই প্রকৃত বাণী ও মাহাত্ম্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। তিনি বিশ্ব ইজতেমা করার জন্য সরকারি জায়গা বরাদ্দ করেন। পাশা-পাশি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত মাহফিলেরও উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু হজব্রত পালন করার জন্য সরকারি অনুদান ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তিনি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। যেমন- ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবে কদর, শবে বরাত। তিনি টেলিভিশন ও বেতারে কুরআনের বাণী ও হাদিস প্রচারের জন্য নির্দেশ দেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিস্তারেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতায় প্রথমবারের মতো রাশিয়াতে তাবলীগ জামায়াত প্রেরিত হয়। অন্যদিকে ইসলামি দেশগুলোর ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ওই দেশগুলোকে সমর্থন দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষ অবলম্বন করেন। শুধু তাই নয় তিনি ফিলিস্তিন যোদ্ধাদের জন্য কয়েক লাখ কার্টন চা প্রেরণ করেন। এমনকি তাঁর উদ্যোগেই রেসকোর্সের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা, মদ-জুয়ার আসর নিষিদ্ধ করা হয়। যেগুলো ইসলামেও নিষিদ্ধ। ব্যক্তিগত জীবনেও বঙ্গবন্ধু ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, একবারই মরে, বারবার মরে না।’ তিনি নিয়মিত ধর্মাচারণ করতেন। সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং রোজা রাখতেন। ৩২ নম্বরের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জানা যায়, তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজও পড়তেন। পবিত্র মাহে রমজানে আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহাকালের মহাপুরুষ, জাতির জনককে স্মরণ করছি এবং তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পরম করুনাময় তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ গঠন করবেন এবং বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

SUMMARY

415-2.jpg