বিশ্বরাজনৈতিক মঞ্চের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু


কামাল সিদ্দিকী 
১৭ মার্চ ।  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন।  এ দিনটা বাঙালি জাতির কাছে অন্যসব দিন অপেক্ষা অনেকটাই বর্ণিল। একটি স্বাধীন জাতি একই সাথে একটি সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে তিনি বিশ্বরাজনৈতিক মঞ্চে মহানায়কের স্থান করে নিয়েছেন। তার এই কৃতিত্বের সাথে আর কারো তুলনা হতে পারে না। যদিও বিশ্বের আরো অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, তাদের নেতা রয়েছে। তবে তাদের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, এরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে স্বাধীন ছিলেন। কোনো কারণে বা কারো আক্রমণের কাছে হেরে তারা তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। তাদের স্বাধীনতালাভ মানেই পুনরুদ্ধার বললে বেশি বলা হয় না। আবার বিশ্বে যেসব দেশ বহিরাগতদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে তারা বাঙালিদের মতো এতবড়ো ত্যাগ আর রক্ত দিতে বাধ্য হননি। আমাদের গণশিল্পী ফকির আলমগীর গেয়েছেন... আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়... আমি...। আমাদের উপমহাদেশের কথাই যদি বলি তাহলে আমরা দেখতে পাবো তাদের ত্যাগের পরিমাণ আমাদের ত্যাগের চেয়ে অনেক কম। যদিও কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিবেচনায় তা যথার্থ নয়। কিন্তু ওজনের মাপকাঠি যখন সৃষ্টির মাপকাঠি হয় তখন সত্যের প্রয়োজনে এসব উদ্ধৃতি বেমানান নয়। ভারতবর্ষ বিভক্তিতে রক্তের সাগর পাড়ি দিতে হয়নি। মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী নিজেই অসহযোগ এবং অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী হলেও তারা রক্ত নিয়ে হোলি খেলেনি। তাই একজন গান্ধিকে স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হয়নি। তবে বিশ্বে আরেকটি বিস্ময় এ উপমহাদেশ লালন করে। সেটি হচ্ছে দীর্ঘ একশ বছর ভারতবর্ষ কোম্পানি নামক একটি বেনিয়াদের হাতে শাসিত হয়েছে। ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লবের পর সরাসরি ব্রিটিশ রাজ এই উপমহাদেশের শাসন দ- নিজ হাতে নেয়। অর্থাৎ এক শতাব্দী আমরা বেনিয়াদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে বন্দি ছিলাম। আবার এই সিপাহী বিদ্রোহকে কার্ল মার্কস বলেছেন, ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন। সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতার পর বিদ্রোহীদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। বয়বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসন দেওয়া হয় সুদূর রেঙ্গুনে। বাহাদুর শাহ জাফর একজন কবিও ছিলেন। নিজের দুর্ভাগ্যকে এভাবেই তিনি কবিতায় বর্ননা করেনÑ ‘কিতনা এই খারাপ নাসেইফ জাফর/ দফনকে লাইনে/ কি গজ জমিন বিভী না মিলি/ কু-ই ইয়র মেন। 
(বাংলা) 
‘জাফর কত খারাপ/ তার কবরের জন্য / তার দায়িত জমিতেও/ দুই গজ দূরেও জমি / ছিল না...
কেম্পানির নাগপাশ ছিন্ন হবার পর ব্রিটিশ শাসকরা তাদের শাসনব্যবস্থায় অনেকটাই পরিবর্তন আনে। সেই সময় বিছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন ভারতবর্ষে গড়ে উঠলেও বৃহত্তর ভারতবর্ষে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েনি। এর ব্যর্থতা আন্দোলনের রূপরেখা নিশ্চিত না করা আর সর্বভারতীয়ভাবে তার আবেদন সৃষ্টি না হওয়া। যদিও বাংলা তখন আন্দালনের সুতিকাগার হিসাবে বিবেচিত ছিল। বাংলাকে তখন বলা হতো ‘হুয়াটস বেঙ্গল থিংকস টুডে নেক্সট ইন্ডিয়া থিংকস টুমোরো।’ অর্থাৎ বাংলা আজকে যেটা ভাবে বাকি ভারতবর্ষ সেটা ভাবে আগামীকাল। আবার ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সেখানে যত লোক বিপ্লবী হয়েছেন কালাপানির দেশে নির্বাসিত হয়েছেন অথবা ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই বাঙালি। প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম যিনি বাঙালি আবার অভিরাম যার হলো দ্বীপ চালান তিনিও বাঙলি। এভাবে অনেকের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে। সেক্ষেত্রে বাংলার বাইরের মানুষের অবদান ততটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু নেতা হবার বিষয়ে তারা কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই বাংলায় মুসলিম লীগের জন্ম হলেও এবং পাকিস্তান প্রস্তাবের উদ্যোক্তা বাঙালি হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জাতির জনক হন উত্তর প্রদেশের মোহাম্মদ আলী জিন্না যিনি ছিলেন তার বংশের দ্বিতীয় মুসলিম। একই কথা খাটে কংগ্রেসের বেলায়। এই দলটিও কিন্তু এই বাংলায় তৈরি হলেও তার মাঝি হন অবাঙালিরা। এভাবে যুগে যুগে বাঙালি বীরত্ব দেখালেও তার কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। উপরন্তু ভিতু বাঙালি বলে উপহাস আর অপবাদ দেওয়া হতো। তাই বাংলার স্বাধীনতা বিশ্বের আর দশটি দেশের স্বাধীনতা থেকে ভিন্ন।
বাঙালি কোনদিনও স্বাধীন ছিলো না। এর আগে স্বাধীনতার নামে যা বলা হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে সত্যই তারা কেউ বাঙালি ছিলে না। এরা ভিন্নভাষী ভিন্ন এলাকার মানুষ। আর তখন বাংলা একক কোনো দেশ ছিলো না। যেমন আলীবর্দি খাঁ। আবার তার দৌহিদ্র নবাব সিরাজুদৌলা কোনোভাবেই বাঙালি ছিলেন না। আর বাংলার সীমানায় তখন বিহার উড়িষ্যা ছিলো। ফলে ঐতিহাসিক সত্যিÑ বাংলা কখনোই বাঙালিদের হাতে শাসিত হয়নি। তবে ১৯৭১ সালেই প্রথম বাঙালি তার বন্ধ্যাত্ব ঘোচায়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। যার নেতৃত্বে এবং ডাকে সেদিন বাঙালি জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে সেই মহান নেতা জাতির জনকের আজ ৯৯তম শুভ জন্মদিন।
১৯২০ সালের আজকের এই দিনে সাবেক ফরিদপুর হালের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এই মহান নেতার জন্ম হয়। যার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান আর মায়ের নাম শেখ সায়েরা খাতুন। 
সেদিনের এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া ওই শিশুটিই একদিন নিজেকে গড়ে তুললেন বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে। তিনি যে বাঙালির নেতৃত্ব দেবেন সেটি ছোটোবেলা থেকেই তার শিক্ষক এবং ছাত্রবন্ধুরা বুঝতে পেরেছিলেন। তার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা থেকে। তিনি যখন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র তখন শিক্ষক হিসাবে পান অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে। সে সময় নিয়ম ছিলো, ছাত্রদের সন্ধ্যার আগেই হোস্টেলে ফিরতে হবে। এই আইনটি শেখ মুজিবের জন্য বড়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। তার সমাধানে এগিয়ে এলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান। তিনি এক নিষ্পত্তি করে দিলেন। রাত করে ফিরলেও সেদিনের শেখ মুজিব আর আজকের জাতির জনকের কোনো কৌফিয়ত দিতে হয়নি। সাইদুর রহমান বলতেন, তোমাকে নেতা হতে হবে। আর তোমাকে অবশ্যই গ্রাজুয়েট হতে হবে। কারণ, পাকিস্তানের নেতা মি. জিন্নাহকে বলা হতো আন্ডার মেট্রিক ব্যারিস্টার। এর পেছনে যে রহস্য ছিল তা এমনি, ব্রিটিশরা পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষায় হিন্দুদের সমকক্ষ করতে একটি অভিনব প্রথা চালু করে। কোন মুসলিম ছেলে মেট্রিক পাশ করলে আর সে ইচ্ছে করলে তাকে ল-নে ব্যারিস্টারি পড়ার সুযোগ দেওয়া হতো। এই আইনেই মি. জিন্না ব্যারিস্টারি পড়ার সুযোগ পান। 
বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে কি বিশাল মাপের নেতা ছিলেন সেটি আজ কিংবদন্তি। কিউবার মহান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ যখন বঙ্গবন্ধু এই বিপ্লবীর সামনে দৃঢ়প্রত্যয়ে বললেন, পৃথিবী আজ দুভাগে বিভক্ত একটি শোষক অন্যটি শোষিত আমি দ্বিতীয়টির পক্ষে। পোড়খাওয়া বিপ্লবী তখন বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমার ভয় হয় আজ থেকে একটি বুলেট আপনাকে তাড়া করে ফিরবে। 
সেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারালাম সেই বুলেটের আঘাতে। সামনে বুক পেতে বীরের মতো বুলেট ধারণ করে তিনি আরো একবার জাতিকে ঋণী করে গেলেন। জয়বাংলার মন্ত্রকে শুদ্ধ করে আবারো তিনি আমাদের চেতনাকে শাণিত করতে আজ জন্মদিনের বাসরে হাজির। বীর বাঙালি তার প্রিয় নেতা আর জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়। ...যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই 
যদি রজপথে ফের মিছিল হতো...
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিচাই বঙ্গবন্ধুর মুক্তিচাই
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা আর 
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা
যদি রাত পোহলে শোনা যেত.....

SUMMARY

410-1.jpg