মোতাহার হোসেন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাস থেকে, বাঙালির হৃদয় থেকে তাঁকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। একই সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথা ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। নতুন প্রজš§কে জাতির বীরত্বের, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি । এ অবস্থা ছিল ‘৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর। কিন্তু বাস্তাবে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ১৭ কোটি মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়নি। বরং দিন যতই যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, তাঁর রাজনৈতিক, দর্শন, মানব দর্শন, মানব প্রেম, জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির দর্শন ক্রমেই নিত্য অপরিহার্য হয়ে ওঠছে। ২০০৮ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকায় জাতির জনকের অসমাপ্ত স্বপ্ন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি তথা সোনার বাংলা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়নের পথে। ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু শেক মুজিব, শেখ হাসিনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি দল আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। এমনি অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত এসব ষড়যন্ত্রকারিদের দমন করা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আরো অধিক মনযোগী হওয়া। অবশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে জানতে, বিশ্বকে জানাতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ মোতাহার হোসেন এর ‘বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ নামক একটি তথ্যবহুল, ঘটনা বহুল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ৪৪টি প্রবন্ধ এতে স্থান পেয়েছে। ২০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দাম রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। অনুরুপ বঙ্গবন্ধুর ১০০ ভাষণ নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা সম্ভার’ শিরোনামে আরেকটি বই প্রকাশ করছে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন। এর মুখবন্ধ লিখছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত এ কে আবদুল মোমেন সম্প্রতি এই বই প্রকাশের ঘোষণা দেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে জানবার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ থেকে নির্বাচিত ১০০ ভাষণ নিয়ে‘ প্রকাশিত বইও অন্যমত সহায়ক হতে পারে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী ভিত্তিক বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি নি:সন্দেহে মহতী উদ্যোগ। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, ভারতের পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে। সম্প্রতি সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের এতথ্য জানান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী এই চলচ্চিত্র পরিচালনায় বাংলাদেশের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তাকে সহযোগিতা করবে। পা-ুলিপি তৈরির পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে নিয়ে মূল কাজ শুরু হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনী চিত্র নির্মাণে ভারতের পক্ষ থেকে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল, গৌতম ঘোষ এবং কৌশিক গাঙ্গুলীর নাম প্রস্তাব করা হলেও পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া শ্যাম বেনেগেলকেই বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ। শ্যাম বেনেগাল নেতাজী সুভাষ বোসকে নিয়ে জীবনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার কর্মের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়ে তাকে নির্বাচন করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল থাকবেন। যেখানে চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধুকে জানেন চেনেন এমন একজন এবং ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে চেনেন এমন একজন ইতিহাসবিদ থাকবেন। এরা পরিচালককে সহায়তা করবেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের জীবনী ভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র এবং বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে ২০১৭ সালের ২৭ অগাস্ট নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে একটি চুক্তি হয়। পরে বাংলাদেশের ১০ জন এবং ভারতের নয়জনকে নিয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়।মূলত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে, তার মত একজন মহান নেতাকে নিয়ে চলচ্চিত্রটি মানুষ আজকে নয় এর পরের এবং তার পরের প্রজন্মও যেন বারবার দেখে এবং স্মরণ করে আমরা কেমন নেতা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের অনেক শিল্পী চলচ্চিত্রে থাকবেন। অন্য কোনো দেশ থেকে কলাকূশলী নেওয়ার স্বাধীনতাও পরিচালকের ওপর থাকবে। অনেক সময় শিল্পীর স্বাধীনতা প্রয়োজন, শিল্প সৃষ্টির সেই স্বাধীনতাটা আমরা দিতে চাই। এই চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কোন অভিনেতা অভিনয় করবেন সেটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত করতে হবে বলে মনে করছেন এক সময় ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারানা হালিম। তিনি বলেন, “পরিচালককে অনেক কিছু টেস্ট করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর হাঁটা-চলা সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কিছু সেটা মিলিয়ে দেখেন, স্ক্রিন টেস্ট করেন। আমরা আশা করব, বিশ্বমানের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে যা যা প্রয়োজন সেই সহযোগিতাগুলো ভারতের কাছ থেকে পাওয়া যাবে।” বঙ্গবন্ধুর জীবনী ভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক মানের হবে। বিশ্বের একজন অন্যতম নেতাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রটি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। এই চলচ্চিত্র তৈরিতে বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশ খরচ বহন করবে, বাজেট করবেন পরিচালক। বাংলাদেশ ৮০ শতাংশ খরচ বহন করতে চায় বলে ভারতকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের পরিচালকদের শর্ট লিস্ট করা হয়েছে। সেখানে প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের নামও আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের পরিচালককে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জানিয়ে তারানা বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্ম দিয়ে কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। এদিকে, ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাহদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে শিল্পির তুলিতে বঙ্গবন্ধুকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন। কবিতা, গাণে, গল্পেও স্মরণ করা হয় প্রতি বছর জনকের জš§দিন, মৃত্যুবার্ষির্কীতে। দেশের খ্যাতিমান ও তরুণ ৫০ জন শিল্পী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর আঁকলেন বিভিন্ন ঘরানার চিত্রকর্ম। শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন, সংগ্রাম ও নানা কর্মময় জীবনের ঘটনাবলীর ওপর এ সব চিত্রকর্মে তুলে ধরেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে এক আর্টিস্ট ক্যাম্প শিল্পীরা এ সব ছবি এঁকেছেন। এই আর্টিস্ট ক্যাম্পের শিরোনাম হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু ও আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এর আয়োজন করে। আর্টিস্ট ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী। উদ্বোধনী ভাষণে শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এবারও একাডেমি আর্টিস্ট ক্যাম্প আয়োজন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। আমাদের খ্যাতিমান, তরুণ ও নবীন ৫০জন শিল্পী এই ক্যাম্পে বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে নিজেদের প্রজ্ঞাকে উপস্থাপন করছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতই ছবি আঁকা হবে, তাঁর সংগ্রামের বিষয়গুলো ততই চিত্রকর্মে উঠে আসবে। জাতির পিতার ওপর গত কয়েক বছর ধরেই একাডেমি আর্টিস্ট ক্যাম্প, আর্ট ক্যাম্পসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। শিল্পীদের আঁকা এই সব চিত্রকর্ম একাডেমিতে সংরক্ষণ করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এইসব সংগ্রহে রাখবেন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর আদর্শকে ধারণ, লালন করেই তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্ন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে সকলইে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তবেই দেশ জাতির উন্নয়ন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।