মোতাহার হোসেন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জš§ দিন পালিত হলো গত ৮ আগস্ট, এটি ছিলো তাঁর ৮৯তম জš§দিন। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনি এই পরিচয় সীমাবদ্ধ নন। তাঁর জীবন, তাঁর কর্ম, তাঁর শ্রম, তাঁর মানব প্রেম, রাজনীতি, সমাজ-সংসার অর্থনীতি নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর চিন্তা সর্বোপরি তাঁর সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল্যায়ন, স্মৃতিচারণ, নিকটজনদের অভিমত প্রভৃতির আলোকে এটা বলা সংগত যে, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছিলেন, একটি ‘নক্ষত্র’। নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হয় পৃথিবী নামক উপগ্রহ, জ্যোতি ছড়ান একই সাথে অন্যন্যা উপগ্রহকেও আলোকিত করছে নিরন্তর। ঠিক তেমনি এই মহীয়ষী মাতা নক্ষত্রের মতো জ্যোতিতে আলোকিত, উজ্জীবিত করেছেন জাতির জনককে, তাঁর পরিবারকে, তাঁর দলকে, সর্বোপরি বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে নিরন্তর আলো ছড়িয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। এই বিবেচনায় তিনি অন্ধাকারে জোনাক পোকা, বাংলার আকাশে নক্ষত্রের জ্যোতি হয়ে সমাজ, পরিবার, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও সময়ে, অসমেয়, দু:সময়ে, দূর্দিনে জাতির পিতার অনুপস্থিতি, তাঁর জেল জীবনে আগলে রেখেছেন সংসারকে, আওয়ামী লীগের মতো সর্ববৃহৎ দলকে উজ্জীবিত করেছেন, নানা পরামর্শ দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, অর্থ দিয়ে। বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম সূচিত হয় মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে যায় চূড়ান্ত সংগ্রামে। যার ফলশ্রুতিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ। বায়ান্ন থেকে একাত্তর অব্দি যে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, সেই সংগ্রামে বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুজিবের পেছনে ছায়ার মত ছিলেন, ছিলেন পরামর্শদাতা, ছিলেন সহাস, অনুপ্রেরণা দাতার ভূমিকায়। বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে চির সংগ্রামী মুজিবকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি আগলে রেখেছিলেন অপার মমতা ও ভালবাসা দিয়ে, সংগ্রামের সাহস দিয়ে, তিনি হচ্ছেন বেগম মুজিব। যাঁর ছিল না কোন লোভ, মোহ, যিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব আপোষহীন নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের যে নবধারা সূচিত হয়, সেই থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনে বেগম মুজিব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস ঘটিত হয়েছিল। এ নিউক্লিয়াসের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সংগঠন, আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে আপোষহীন ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ছাত্র তরুণ সমাজের প্রধান এবং সর্বাত্মক প্রেরণার উৎসস্থল ছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে নেতৃত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোনো সংকটের কাল ছায়া ঘনিভূত হয়েছে, বেগম মুজিব সেই কাল ছায়া দূর করার জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃস্বার্থভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পিছনে। তিনি একদিকে কিছু কিছু টাকা জমিয়ে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য বাদবাকি প্রায়োজনীয় টাকা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিবারের বসতির জন্য বঙ্গবন্ধু ভবন খ্যাত ৩২ নম্বর বাড়িটির কাজ সুসম্পন্ন করেন। তিনি সংসার সামলাতে ছিলেন পারঙ্গম এবং পরম মমতায় পুত্রসম ভাগ্নে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি নিজ পুত্র শহীদ শেখ কামাল শেখ হাসিনা, ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, শহীদ শেখ জামাল এবং কনিষ্টপুত্র শেখ রাসেলের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সব দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পিছনে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল, তাও তিনি করেছেন। ১৯৬২ সালের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন অন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। সেই সময়ে আন্দোলন পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন বঙ্গবন্ধু প্রেরিত বার্তা অনুযায়ী ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেগম মুজিব। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা, ৬ দফার আলোকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখেন সেই নেতৃত্বে পেছনেও বেগম মুজিব ছিলেন ছায়ার মত। ৬ দফা কেন্দ্রীক আন্দোলন প্রচার প্রচারণায় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এক লৌহ কঠিন ঐক্যের কাতারে নিয়ে আসে। তৎকালীন, বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা ছড়িয়ে পড়েন শ্রমিক ও শিল্পাঞ্চলে। শহর থেকে গ্রাম অব্দি আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলন এক পর্যায়ে রাজপথের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এর বিষ্ফোরণ ঘটে ৬ দফার আলোকে আহুত শ্রমিক ধর্মঘটে, যে আন্দোলনে শহীদ হন শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ অনেক শ্রমিক। আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সকল শিল্পাঞ্চলে। সেই অন্দোলনেও বেগম মুজিবের সূচিন্তিত ও দৃঢ় মনোভাব আন্দোলনকামীদের উৎসাহ যুগিয়েছিল। আন্দোলন দমাতে সামরিক শাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) দায়ের করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে আবারো কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের এই পর্যায়ে আপোষকামি চক্র নিরব ভূমিকা পালন করে। এ পর্যায়ে বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতারা এই আপোষকামী ধারাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যায়। ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছাত্র জনতার পক্ষে ঐতিহাসিক রমনা রেস কোর্স ময়দানে ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের বরমাল্য ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি নিয়েই বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যান সত্তরের নির্বাচনের দিকে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের প্রাক্কালে সামরিক জান্তা একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। জান্তার গুলিতে শহীদ হন আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে আসে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সেই মিছিলে স্লোগান উঠে ‘জহুর জহুর জ্বাল আগুন- যায় না যে সহা’। শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শামসুজ্জোহা। আসাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয় কবি লেখেন ‘আসাদের রক্তমাখা শার্ট আমার পতাকা’। শহীদ হন নব কুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। ছাত্র জনতার বিক্ষোভ রুপ নেয় বিদ্রোহে। ইতিহাসের এই পর্যায়ে বেগম মুজিবের দৃঢ় ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোল টেবিল আলোচনায় সামরিক জান্তা আইয়ুবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু। অথচ আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা বঙ্গবন্ধু ভবন ৩২ নম্বরে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসেন এবং প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বেগম মুজিব নেতাদের এ প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে বেগম মুজিব কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তবুও সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্র চলে রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে শেখ মুজিব পেরোলে মুক্তি পাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানি শাসকের সমস্ত পরিকল্পনা ল-ভ- হয়ে যায়। সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দু:খজনক হলেও সত্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা করে। শুরু হয়ে যায় পূর্ব বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কালজীয় ভাষণ, স্বাধীনতা ঘোষণার নেপথ্যেও রয়েছে বেগম মুজিবের সুচিন্তিত পরামর্শ। এই অনুষ্ঠানে আসার আগে বঙ্গবন্ধুকে বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘তোমরা নিজের মন যেটা চাইবে, নিজে যেটা ভাল মনে করবা তাই তুমি ভাষণে বলবা, কারো কথা শুনে কিছু বলবা না। কারণ এদেশের মানুষের জীবন, ভাগ্য তোমার ওপর নির্ভর করছে।’ বঙ্গবন্ধু ঠিক তাই করেছিলেন সেই উত্তাল জনসমুদ্রে মুক্তিকামি জনতার সামনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জš§বার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত তাঁর পরিবারের অপরাপর সদস্যদের। এবং তাঁদের বিদেহী আত্মারা মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।