শোকাবহ আগস্ট মাস। অতি করুণ স্মৃতিবিজড়িত এ মাসে বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় ফিরে পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পারেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তরুণ শেখ মুজিব তখনই বুঝতে পেরেছিলেন নিজের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতিকে আবারো লড়তে হবে। প্রথমেই আঘাত আসে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়ান পাকিস্তানি এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। আর তখন থেকেই তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এর সূত্র ধরেই পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু এ আন্দোলনে উৎসাহ জোগাতে থাকেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেরুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায়। এদিন ঢাকার রাজপথে শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয় সেদিনই। এরপর আস্তে আস্তে স্বাধীনতার সংগ্রাম এগোতে থাকে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলনের অগ্রপথিক। তারই ধারবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা জাতির সামনে পেশ করেন। ৬ দফাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে শুরু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে ভেসে যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। জেল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির নেতৃত্বের হাল ধরেন। তিনি হয়ে ওঠেন সমগ্র বাঙালি জাতির মুকুটহীন সম্রাট। এরপর আসে সত্তরের নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যস্ত। এরই মধ্যে ১২ নভেম্বর রাতে ইতিহাসের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাতহানে উপকূলীয় এলাকায়। লাখ লাখ মানুষ মারা যায় ওই ঘূর্ণিঝড়ে। গৃহহারা হয় অসংখ্য মানুষ। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার দল নির্বাচনি প্রচারণা ফেলে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান ত্রাণ সহায়তা নিয়ে। তিনি গঠন করেন ত্রাণ কমিটি। বাংলার মানুষ মুক্তহস্তে দান করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিলে। তিনি একাধারে নির্বাচন ও দুর্গত মানুষের ত্রাণ সহায়তা অতি দক্ষতার সাথে একহাতে সামলাতে থাকেন। নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। এতে ফুঁসে ওঠে বাঙালি জাতি। এরপর আসে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের সেই ভয়ঙ্কর কাল রাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। অবশ্য জাতির জনকের সামনে যতগুলো চ্যালেঞ্জ এসেছিল তিনি তার সবগুলোই সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন।দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাতির জনক ফিরে আসেন তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৪ সালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার লঙ্গরখানা খুলে দরিদ্র মানুষের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। সফলভাবে তিনি দেশের খাদ্যাভাব মোকাবিলা করেন। এরপর দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘এক ইঞ্চি অনাবাদি জমি ফেলে রাখা যাবে না’। বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে। অল্পদিনের মধ্যে বেড়ে যায় দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া কৃষক লীগের কর্মীরা মাঠে মাঠে গিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। চালের দাম কমে যায়। দেশ যখন খাদ্যে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে চলছে এ সময়ে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির জনককে হত্যার ষড়যন্ত শুরু করে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশের অগ্রগতি পিছিয়ে দেয়।