ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
আগস্ট মাস । এই মাসে জাতির পিতাসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। জাতীয় ও আন্তজাির্তক চক্রান্তে পরিবারসহ তাকে ১৫ আগস্ট হত্যা করে সমগ্র জাতিকে হতবাক করে দিয়েছে। জাতি আজ শোকে মূহ্যমান। বাঙালির বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একটি অভিন্ন নাম। কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধু অভাবী মানুষের জন্য হিতকর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছিলেন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠ। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বতর্মান মওলানা আজাদ কলেজ) পড়ার সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর্র নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বঙ্গবন্ধু প্রথম ধাক্কা খেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষের কাছে। চতুথর্ শ্রেণির কমর্চারীদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বহিষ্কৃত হলেন। মাথা নোয়ালেন না। বুঝলেন সাধারণ মানুষের জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানি চক্রের অভিসন্ধি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করল প্রথমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করার হঠকারী সিদ্ধান্তে। তারপর সামরিক-বেসামরিক চাকরি, শিল্পায়ন ইত্যাদিতে পবর্তপ্রমাণ বৈষম্যে। ধমের্ক শিখÐী রেখে যে পাকিস্তান, যেখানে চরম অধমর্! বঙ্গবন্ধু বাংলার মাঠেঘাটে, হাটখোলায় সমাবেশ ও জনসংযোগ করে বাংলার মানুষের কাছে সেসব বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেন। ফলে জীবনের অধের্কটা সময় দুঃসহ কারাবরণে বাধ্য হন তিনি। তবে এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু পূবর্ বাংলার জনগণকে এক পতাকার তলে নিয়ে এসেছিলেন। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল পূবর্ বাংলার বঞ্চিত দুঃখী মানুষকে সুখের সন্ধান দেয়া। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তিনি রাজপ্রাসাদ পরিহার করে অরক্ষিত বাসভবনে অবস্থান করা শুরু করলেন। উদ্দেশ্য, সবার সঙ্গে এক হওয়া। সাবেকী শাসনব্যবস্থায় তা সহজ ছিল না ভেবে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নিজের মতো করে পরিবতর্ন করতে চাইলেন। তত দিনে বৈজ্ঞানিকওয়ালারা এবং পাকিস্তানপ্রেমী স্বাধীনতাবিরোধীরা ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু করেছে। তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই তাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। দেশের মানুষ অকল্পনীয় নৃশংসতায় বিমূঢ় হয়ে গেল। প্রতিক্রিয়ার কাঠস্বরকে বন্দুকের নল দিয়ে সাময়িক স্তব্ধ করা হলো। তবে কত দিন? বাংলার জনগণের আশীবাের্দ প্রায় দুই যুগ পরে বঙ্গবন্ধুর সাথর্ক উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন। চারপাশে স্তাবকের দল ভিড় জমাল। তবে সবার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর স্থান সমান হলো না। কারণ প্রায় দুই যুগ ধরে স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর নামে যেসব মিথ্যার জঞ্জাল স্ত‚পীকৃত করেছিল, তাতে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। বঙ্গবন্ধু আত্মপরিচয় ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রথমে তিনি মানুষ তারপর বাঙালি এবং তার ধমর্ ইসলাম। ধমের্র নামে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাধারী ব্যক্তিদের তা ভালো লাগার কথা নয়। কারণ তারা মানুষের ধমের্র চেয়ে ধমের্র মানুষের প্রাধান্য দেয় বেশি। তারা এর বিকৃত প্রচার করেছে। দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বে বঙ্গবন্ধু নিজেকে শোষিতের পক্ষে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শোষিতের পক্ষের তাত্তি¡ক ঘরানার মানুষ আমাদের দেশেও আছে, তবে স্বাথের্র দ্ব›েদ্ব বহুধাবিভক্ত। তাদের বক্তব্য : জনগণকে প্রস্তুত না করেই নাকি বঙ্গবন্ধু বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে, মানুষ হত্যার জন্য তিনি তা করেননি, বরং খেটে খাওয়া মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য শাসন প্রক্রিয়ার পরিবতর্ন আনতে চেয়েছিলেন। এত সব মহোত্তম চেতনাকে জ্ঞানপাপীরা নেতিবাচকরূপে ব্যাখ্যা করেছে। কে না জানে বিকৃত রটনা মানুষ না বুঝে উপভোগ করে। দুঃখ হয়, এরা অপপ্রচার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের মন থেকে যতুটুকু সরিয়ে আনতে পেরেছে তার চেয়ে বেশি বিধ্বংসী হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামের লেফাফা পরে যারা নানা অপকমের্র মাধ্যমে আখের গুছিয়েছে। এদের চিহ্নিত করে নিরাসক্ত শুদ্ধ অভিযান চালালে, মতাদশের্র ঊধ্বের্ থেকে বঙ্গবন্ধু সমহিমায় অধিষ্ঠিত থাকবেন বলে আশা করা অসংগত নয়। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পযর্ন্ত বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষে একটি মিনি পাকিস্তান হিসেবে কাযর্কর ছিল। এতে যেমন অবদান ছিল জিয়ার, তেমনভাবে অবদান ছিল এরশাদ আর খালেদা জিয়ার। তবে জিয়া আর তার স্ত্রীর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। জিয়া শীষর্স্থানীয় অনেক রাজাকারকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী আর উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন। অন্যদিকে এরশাদ মাওলানা মান্নান আর সাকা চৌধুরীর মতো ঘাতকদের তার মন্ত্রিসভায় ঠঁাই করে দিয়েছিলেন। আর খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে তার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূণর্ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। খুনি কনের্ল রশীদকে জাতীয় সংসদের সদস্য করে নিয়ে আসেন (ফ্রিডম পাটির্)। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাবির্ক চরিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল। এই সময়ে দেশে এমন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছিল, যে প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা পাকিস্তানি ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদির ব্যাপারে নানা উন্মাদনা প্রদশর্ন করতে দ্বিধা করেনি। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার সময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ব্যানার নিয়ে বসে থাকত। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার পিতার মৃত্যুর ২১ বছর পর সরকার গঠন করলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। তবে তাকে যেতে হবে অনেক দূর এবং এটা এখন পরিষ্কার যে তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে দেশে নিরন্তর ষড়যন্ত্র চলমান। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই বাইরের মানুষ তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রের প্রশাসনে থাকুক বা দলের ভেতর, তাদের যদি বঙ্গবন্ধুকন্যা চিনতে ভুল করেন তাহলে আবারও একটি বিপযর্য় অনিবাযর্ হয়ে উঠতে পারে। নাগালের মধ্যে যাদের অবস্থান তাদের অনেক সময় চেনা যায় না। বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি বলে জাতিকে ২১ বছর খেসারত দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না বলে সবার প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। রাজনীতিতে আজও আদশর্ আছে, বঙ্গবন্ধুর দশর্ন আছে, আছে তার কমর্ আমাদের সামনে আলোকবতির্কার মতো। কিন্তু এর যথাযথ অনুসরণের অভাব আছে নিশ্চয়ই। তা না হলে পরিপূণর্ভাবে সোনার বাংলা আমরা এখনো পেলাম না কেন? তবে বিলম্ব মানেই থেমে যাওয়া নয়; ধীর মানেই স্থবিরতা নয়। আজ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, অন্তত দৃশ্যমান অগ্রগতিÑ তা থেকে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এখন শুধু মানবিক ও চারিত্রিক গুণাবলি অজের্নর পালা। এটা সংগ্রামও বটে। এই সংগ্রাম করতে হবে নিজের সঙ্গে নিজের। কারণ, ‘সোনার মানুষ’ গড়ার প্রক্রিয়াটি শুধুই সামষ্টিক, তা বলা যাবে না। ব্যক্তিগতভাবেও এ প্রক্রিয়ার সূচনা করা এবং তা অব্যাহত রাখা বাঞ্ছনীয়। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে জাতির চেতনাবোধকে জাগ্রত করব। আমরা প্রত্যেকেই যদি পাল্টে যাই, বাংলাদেশ পাল্টে যাবে নিশ্চয়ই। আমরা প্রত্যেকেই যদি সোনার মানুষে পরিণত হই, বাংলাদেশ হয়ে যাবে সোনার বাংলা অবধারিতভাবে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধিকারের জন্য যিনি নিজের জীবন উৎসগর্ করেছিলেন, হাজার বছরের সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে জীবন দিতে হয়েছিল এই দিনে। শুধু তাকে নয়, সেদিন হত্যা করা হয় ধানমÐি ৩২ নম্বরের বাসায় থাকা তার পরিবারের সবাইকে, এমনকি তার শিশুপুত্রকেও। সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ আরও অনেককে। সেনাবাহিনীর একটি দলছুট অংশ সরাসরি হত্যাকাÐে অংশ নিলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেদিন কারা কারা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিল। কারা সেদিন যোগ দিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে। তাদের সেই ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। হয়তো চলতেই থাকবে। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে তখন চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল শুধুই ধ্বংসস্তূপ, পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার ছাপ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য। ছিল না দক্ষ প্রশাসন। এরই মধ্যে পাকিস্তান কারাগারের ফঁাসির মঞ্চ থেকে রক্ষা পেয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। শুরু করেছিলেন দেশ গঠনের নয়া সংগ্রাম। মাত্র সাড়ে তিন বছরে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে দেশকে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তখনই হায়েনারা রাতের অন্ধকারে এই হত্যাকাÐ ঘটায়। বাহ্যত দলছুট কিছু সেনা সদস্যকে কাজে লাগালেও পেছনে ছিল অনেক বড় নীলনকশা। ব্রিটিশ সাংবাদিক মাসকারেনহাসসহ অনেকেই তুলে ধরেছেন সেই ষড়যন্ত্রের অনেক অজানা কথা। কুমিের্টালা গলফ ক্লাবে কবে, কখন ঘাতক রশীদ বৈঠক করেছিলেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। খন্দকার মোশতাক, তৎকালীন মাকির্ন রাষ্ট্রদূত কীভাবে ষড়যন্ত্রের জাল গুটিয়েছিলেন। অনেক কিছুই আজ স্পষ্ট। স্পষ্ট হয় পরবতীর্ ঘটনামালা থেকেও। রাষ্ট্রদূত বানিয়ে ঘাতকদের পুরস্কৃত করা, ইনডেমনিটির ঘোষণা দিয়ে খুনিদের বিচার রোধের অপচেষ্টা, স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা, একাত্তরের ঘাতক আব্দুল আলীমসহ রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রী করা, গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনবাির্সত করাÑ এমনি অনেক ঘটনাই প্রমাণ করে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রে কারা যুক্ত ছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করলে প্রচলিত আইনে হত্যাকাÐের বিচার শুরু হয়। বিচারিক প্রক্রিয়ায়ও উঠে আসে ষড়যন্ত্রের নানা দিক। বিচারের রায় অনুযায়ী কয়েকজন খুনির মৃত্যুদÐ কাযর্কর করা হয়েছে। কিছু খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কাযর্কর করার মাধ্যমে জাতিকে সম্পূণর্রূপে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। শোকের মাস শেষ হতে যাচ্ছে। আমাদের শপথ হোক, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে আমরা আন্তরিকভাবে তৎপর হব। স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী সব ষড়যন্ত্র কঠোরভাবে মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নেব। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: কলামিস্ট ও গবেষক ভড়ৎয়ধহ.রহভড়@মসধরষ.পড়স