বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা

ডা. এস এ মালেক  
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানের পর পরই পুলিশ ও ইপিআর অস্ত্র নিয়ে তাদের কর্মস্থল পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। আনসার বাহিনীর অগণিত সদস্যও যোগদান করেছিল। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। এটাও ছিল গেরিলা যুদ্ধের আরেক নির্দেশ। তিনি বললেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশালস্নাহ।'
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির একটা গৌরবজ্জ্বল দিন। ওই দিন বাঙালি জাতির জনক মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সমগ্র জনতা ও জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ইউনেস্কো তাকে পৃথিবীর একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওই স্বীকৃতির কারণে বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই গর্বিতবোধ করে। ইতিহাসের এমন এক বিপর্যয়কালে ভাষণটি দেয়া হয়েছিল, যখন '৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানালেন ও আসন্ন জাতীয় সংসদে দাবি উত্থাপনের পরিকল্পনা করলেন, তখন ৩রা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনের তারিখ ঘোষণার পরেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করা। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অর্থ্যাৎ ৩ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের শাসন অকার্যকর করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় বাংলাদেশের শাসন কার্য চলছিল। প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় পর্যন্ত সব সরকারি, আধা-সরকারি কার্যালয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছিল। সে দিন একজন নির্বাচিত নেতা হিসেবে ভোটের অধিকার বলে একজন রাজনৈতিক নেতা কিভাবে রাষ্ট্র গঠন করবার পূর্বেই তার জনগণকে শাসন করতে পারেন, ইতিহাসে এরূপ এক ব্যতয় ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আসলে অসহযোগ আন্দোলন হয় ৩রা মার্চ থেকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিনে তখন বাংলাদেশের মানুষের কি করণীয় সেই দিকে নির্দেশনাই মার্চের ভাষণে দেয়া হয়েছিল। ওই ভাষণের শেষ কথা ছিল- "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" ওই আহ্বানের মাধ্যমেই জনগণকে বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন তার ২৩ বছরের আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা নয়, লক্ষ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"- এ কথা বলার পর আর কি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন ছিল? এরপরও ২৫ মার্চ বাঙালি জাতি আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। আইন সংগতভাবে বলতে হয় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার একমাত্র অধিকার '৭০-এর নির্বাচনের একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হওয়া একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল। তাই স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অন্য কাউকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। সার্বিক অর্থেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। বাঙালি জাতির জনক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাই তিনি চিরঞ্জীব। যদি ৭ মার্চের ভাষণের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করি, তাহলে আমরা দেখতে পারব শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়- এ ভাষণ ছিল একজন সামরিক নায়কের। একজন সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ান কিভাবে যে এ ভাষণ দিতে সক্ষম হলেন, তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতির এক শুনিপুণ নির্দেশনা। নিরস্ত্র বাঙালিকে তিনি সরাসরি হানাদার বাহিনীর সম্মুখীন হতে বলেননি। তিনি ডাক দিয়েছেন তাদের অবরোধ করার, চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়ার। বন্ধ করতে বলেছেন খাদ্য, পানি ও জিনিসসমূহ। বলেছেন, ভাতে মারবেন, পানিতে মারবেন। নির্দেশ দিয়েছেন পাচকদের যেন হানাদার বাহিনীদের রান্না করে না খাওয়ায়। এ সব কথায় স্পষ্ট প্রমাণ করে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল। মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল গণতান্ত্রিক আর ৭ মার্চ ভাষণে তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন- যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করতে। নিরস্ত্র বাঙালির কাছে কিছু ছিল না, তা বঙ্গবন্ধু জানতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানের পরদিনই আমরা সমস্ত সিভিলিয়ানদের কাছ থেকে ৩৭৫টি মেশিনগান সংগ্রহ করে তৎকালীন রাজবাড়ীর মহকুমার শাসক শাহ্‌ ফরিদের বাড়িতে জমা রেখেছিলাম। সেই দিন ড্রাই আইস ফ্যাক্টরিতে সুতার প্রায় ২৫ টন রড ছিল তা দিয়ে প্রায় ৫ হাজার লেজার তৈরি করে ছিলাম। প্রায় ৫ হাজার তীর ধনুক ও চর অঞ্চলের ঢাল শুরকি প্রস্তুত করে তা দিয়ে গোয়লন্দে ২১ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ ছিল অত্যন্ত যুক্তিবহ। 

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানের পর পরই পুলিশ ও ইপিআর অস্ত্র নিয়ে তাদের কর্মস্থল পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। আনসার বাহিনীর অগণিত সদস্যও যোগদান করেছিল। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। এটাও ছিল গেরিলা যুদ্ধের আরেক নির্দেশ। তিনি বললেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশালস্নাহ।'

তিনি আরও বললেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাইয়া রাখতে পারবে না"। যে কথাটা আজ তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলে চলেছেন। উন্নয়নের পথে বাঙালি জাতিকে কেউ দাবাইয়া রাখতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই জানিয়েছিলেন চরম ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। চরম ত্যাগের প্রশ্নে বাঙালি যখন চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত তখন বাংলার স্বাধীনতাকে কেউ প্রতিরুদ্ধ করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর সেই কথা আজ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ৩০ লক্ষ্য বাঙালির এক সাগর রক্তের বিনিময় দেশ স্বাধীন হয়েছে। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছে। মা-বোনের সতীত্ব হারিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা সফল হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাঙালিই দেশ স্বাধীন করেছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার কন্যা আজ বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অবশ্যই কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বাঙালির যে মুক্তির কথা বলেছেন, তার নির্মম হত্যার কারণে আজও তা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। গণমানুষের মুক্তি বলতে সার্বিকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজের কথাই বলা হয়েছিল। ওই শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া আজ নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য কিন্তু একই। তিনিও চান সর্বপ্রকার নির্যাতন নিপীড়ন মুক্ত একটা বাংলাদেশ। দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ। এখানে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষায় ব্যাপারে কোনো মানুষ অবহেলিত থাকবে না। এ জন্যই শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। তবে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওযায় বঙ্গবন্ধু যেভাবে দুঃখী মানুষের কল্যাণ করতে চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনার পক্ষে সেই একই পথ অনুসরণ সম্ভব নয়। কেননা, বিশ্বপরিমন্ডলে যে পরিবর্তন আসছে, তার সঙ্গে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ রেখেই শেখ হাসিনাকে এগোতে হচ্ছে। তবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ থেকে তিনি সরে গেছেন বলে মনে হয় না। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নেই তার লক্ষ্য। পিতার মতো তিনিও স্বাধীনতাকে বাঙালির জীবনে অর্থবহ করতে চান। বিগত ১৫ বছর দেশ শাসন করে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তিনি জাতির পিতার যোগ্য কন্যা। জনগণের আস্থার পের নির্ভর করেই তিনি দেশ শাসন করছেন।৭ মার্চের ভাষণের মূল প্রেরণাকে ধারণ করেই তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করছেন। তার আমলে গরিব দুঃখী বাঙালি যতটা সচ্ছল ও সাবলম্বী হয়েছে, তা আর কারও আমলে ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই শেখ হাসিনা দেশ শাসন করেছেন, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি তাকে ১ নম্বর শত্রম্ন হিসেবে চিহ্নিত করছেন এবং বারবার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সৎ, সাহসী, নির্ভীক, কঠোর পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক শেখ হাসিনা সব কিছু অগ্রাহ্য করে পিতার অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করছেন। কাজ করে যাচ্ছেন। 

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

SUMMARY

384-1.jpg