বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মহাকাব্য

সাধন সরকার 

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পকের্ বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তার ব্যক্তিত্ব ও নিভীর্কতা হিমালয়ের মতো। এভাবেই তার মাধ্যমে আমি হিমালয়কে দেখেছি’। বঙ্গবন্ধু একটি সংগ্রাম, যে সংগ্রাম সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে গজের্ উঠতে শেখায়। বঙ্গবন্ধু একটি ভাষণ, যে ভাষণ পরাধীনতার শিকলে বন্দি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। বঙ্গবন্ধু মানেই প্রেরণা, যে প্ররণা যুগে যুগে সব সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ায়। বঙ্গবন্ধু একটি মানচিত্র, একটি দেশ, বাঙালি জাতীয়তার একটি মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধু মানেই একটি অভ্যুত্থান, একটি ইতিহাস, রাজনীতির কবি, ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীনতার প্রতীক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের স্বজনদের হত্যার ঘটনায় ঘটেনি, পুরো বাঙালি জাতির আত্মা ও স্বপ্নকে হত্যা করা হয়। মুক্তির এই মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনগর্ঠন ও অথৈর্নতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তখনই ইতিহাসের নিমর্ম এ ঘটনা ঘটানো হয়। বাংলা, বাঙালি, বঙ্গীয় বদ্বীপ আর বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গঁাথা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শাসন-শোষণ, বৈষম্য আর অত্যাচার থেকে জাতি চিরমুক্তি চেয়েছিল। আর তখনই গজের্ ওঠেÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যাকে দু’বার চেষ্টা করেও পাকিস্তানিরা মারতে পারল না বা মারতে সাহস করল না তাকে হত্যা করল তার দেশেরই কতগুলো বিশ^াসঘাতক নামের কুলাঙ্গার। যে স¦াধীনতা ও দেশবিরোধী চক্রান্তদের ইন্ধনে জাতির পিতাতে হত্যা করা হয়েছিল তাদের ষড়যন্ত্রের কূটকৌশল এখনো বিলীন হয়ে যায়নি! আশার কথা, জাতির পিতা এখনো জাগ্রত। স্বাধীনতা অজের্নর লড়াইয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যেমন বন্দিশালায় থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তেমনি বতর্মানের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামসহ উন্নত দেশ গঠনে তিনি কবরে শুয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

১৯৪৭ থেকে ’৭০ সাল পযর্ন্ত ২৩ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সোনালি সময়ের প্রায় ১২ বছরই কেটেছে জেলের বন্দিশালায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি এসবের জন্য তার কোনো খেদ ছিল না, ছিল না কোনো আত্মপীড়ন ও দ্বিধা। তিনি কখনো বিচলিত হননি, ভয় পাননি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ছয়টি বাক্যেই বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায়। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণার নাম। ৭ মাচের্ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনা জাগানো ও জাদুকরি ছন্দময় কাব্য সোনার বাংলার পথে-প্রান্তরে আজও ধ্বনিত হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূযর্ ছিনিয়ে আনার সুদীঘর্ পথটি ছিল কখনো সংগ্রামের আবার কখনো রক্তে রঞ্জিত। আবার কখনোবা ছিল অসহযোগের তীব্রতায় এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তার প্রতীক। নিরহঙ্কারী বঙ্গবন্ধু চললেন তার মতো করেই, মুখে হাসি ধরে রেখে মাথাটা উঁচু করে তিনি চলতেন। জাতির পিতা অথৈর্নতিক মুক্তির কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনিই প্রথম মৌলিক অধিকারসহ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধমির্নরপেক্ষতার কথা সন্নিবেশ করেছেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক দলের শক্তির সন্ধান জাতির পিতার নীতি ও আদশর্। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বলেছিলেনÑ ‘এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে’। বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথানত করেননি। তিনি শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। সেই বঙ্গবন্ধুকে কি আমরা মনে রেখেছি? তাই ১৯৭১- এর মতো সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে দঁাড়াতে হবে। রাজনীতিসহ জাতীয় সব বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ আজ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ পথে এগিয়ে চলেছে। ‘এশিয়ার উদীয়মান টাইগার’ খ্যাত বাংলাদেশ বিশে^ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল মধ্যম আয়ের ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত দেশে পরিণত হতো। তিনি বলেছিলেন, রক্ত দিয়ের রক্তঋণ শোধ করে যাবেন। তিনি তা করে গেছেন। এখন আমাদেরও রক্তঋণ শোধ করতে হবে। তাই দেশের তরুণ প্রজন্মসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আগামী দিনের কাÐারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রায় কাজ করতে হবে। তবে দেশের শাসককেও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ভিন্নমতকে সম্মান করতে হবে। কোনো প্রকার সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হত্যা, গুম, শিশুশ্রম, শিশুহত্যা, নারী নিযার্তন, অথর্ লুটপাট, সম্পদ-মেধা পাচার, সবোর্পরি বৈষম্য জাতি দেখতে চায় না। তরুণরাই আগামী দিনের পথচলার শক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ডিজিটাল সোনার বাংলা গড়তে তরুণদেরকে সোনার মানুষ হতে হবে। মুত্যুর পরও দেশের প্রতিষ্ঠাতা দেশ থেকে হারিয়ে যাননি। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন এবং থাকবেন বাঙালির সত্তাজুড়ে। সব বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু নামটি সবর্দা ধ্রæবতারা হয়ে জ¦লছে। এখানে কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাটি প্রাসঙ্গিক-‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরী যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীতির্ তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান’।

SUMMARY

380-1.jpg