মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূইয়া এমপি
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম-শোষণ-বঞ্চনার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অসংখ্য শহীদের রক্ত আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শব্দ দু’টি এক ও অভিন্ন। একজন ছাত্রনেতা মুজিব থেকে নানা সংগ্রাম আর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়েছেন জাতির জনক।
মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়েছেন তিনি। এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির স্বাধীনতার মূলভিত্তি ছয় দফার। এই ছয় দফার মূলভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমরা তার আহ্বানেই জীবনবাজি রেখে নয় মাস যুদ্ধ করেছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুক্তিসংগ্রাম যেভাবে সংঘটিত হয়েছিল, আমরাও সেভাবে মরণপণ লড়াই করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন্ত কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাসে ছিলেন। সে দেশের কৃষ্ণাঙ্গরা তার নামেই শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছিল। ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্নর সংগ্রামী জীবনের চিত্র, ভিয়েতনামের হো চি মিন, তুরস্কের কথা ভাবলেই কামাল আতাতুর্কের কথা এসে যায়। আলজেরিয়া আর চিলির আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে মিশে আছে বেনবেল্লা ও আলেন্দের নাম। এটাই ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারা। ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। আসলে জাতির মুক্তিসংগ্রামে নেতা একজনই। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেলায়ও প্রযোজ্য। দীর্ঘ আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরঙ্কুশ জনসমর্থন এবং সর্বোপরি জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হয়েছিলেন এ জাতির অবিসংবাদিত নেতায়।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি তথা এই স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের ১৩ বছরই কারাগারে ছিলেন। বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। এমনকি পাকিস্তানে বন্দী থাকাকালে তার নামে ও নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তার নামের ওপরই এ দেশের অসংখ্য মানুষ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লড়াই করেছে। সব শ্রেণী পেশার লোক এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান।
১৯৭১ সালে আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল নেতৃত্ব। সেইদিন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে পাকিস্তান সরকারের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র তাক করি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এখানেও আমার চেতনায় কাজ করছিল শেখ মুজিবের আদর্শ ও তার দৃঢ় অবিচল ব্যক্তিত্ব। আজ দুঃখ হয়, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক দেখে। একটি মীমাংসিত বিষয়কে নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ইতিহাসের গতিকে উল্টোপথে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাস সত্যকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারে না। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনো দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকেই একটি ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। সত্যি করে বলতে কি, যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি বাঙালির অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং সেটা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। এখানে একটা কথা বলতে হয়Ñ আমার নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম লড়াই (কুমিড়ার লড়াই) হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায়। সেই যুদ্ধে একজন কর্নেলসহ বিভিন্ন পদের ১৫২ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। কুমিড়ার যুদ্ধে অংশ নিতে তো আমি বা আমার সহযোদ্ধারা কোনো ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলাম না। আসলে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকনির্দেশনা ছিল ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম। আর চূড়ান্ত সিগন্যাল ছিল ৭ মার্চ ১৯৭১, যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের উচ্চতায় কেবল শেখ মুজিবকেই মানায়, অন্য কাউকে নয়। একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, গায়ের জোরে ও অর্থের মানদণ্ডে কখনো নেতা হওয়া যায় না। যার নেতৃত্ব জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে তিনি নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে যান। বঙ্গবন্ধুর মাঝে সেসব গুণ ছিলÑ তাই তো তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক হয়েছেন।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ সাড়ে তিন বছরে তিনি তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নেন। শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন? সফল ছিলেন না ব্যর্থ ছিলেন, এ নিয়ে এখনো গবেষণা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনার তিনি দায়িত্ব নেন। দেশ তখন ছিল একটি ধ্বংসস্তূপ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ভাঙা, রেল যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন, সমুদ্র বন্দরগুলো অকেজো, কলকারখানা অচল, খাদ্য গুদামগুলো খালি ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল শূন্য। দেশে কোনো বেসামরিক বিমান সংস্থা ছিল না, শিপিং করপোরেশনের কোনো সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল না। এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে তার সামনে প্রথম ও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রায় তিন কোটি ছিন্নমূল মানুষের গৃহনির্মাণ, খাদ্যসংস্থান করে পুনর্বাসন করা। এরপর ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, উৎপাদনব্যবস্থার পুনর্গঠন, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ লাভ এবং পাকিস্তানে আটকে থাকা অসংখ্য বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনা। বঙ্গবন্ধু শুরুতেই একটি শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সেই ধারাবাহিকতায় কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু শুরুতেই তিনি অপপ্রচার তথা ষড়যন্ত্রের শিকার হন। এরই সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলগুলো ভেতরে ভেতরে সশস্ত্র ও নাশকতামূলক তৎপরতা শুরু করে। তারা সফল হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। অথচ সে সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশকে পুনর্গঠন করা একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। শূন্য কোষাগার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো আর কোনো সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে দেশের হাল ধরতে হয়নি।
বহির্বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর ইমেজ ও তার অসাধারণ ক্যারিশমা এবং জনসাধারণের ওপর তার তুলনাহীন আস্থা ও বিশ্বাস বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাকে সহায়তা করছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট মেরামত করে যোগাযোগব্যবস্থা আবার চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার হাত দিয়েই বাংলাদেশে নিজস্ব বিমান সংস্থা, নিজস্ব বাণিজ্যিক জাহাজ যাত্রা শুরু করে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গড়ে ওঠে নৌ ও বিমানবাহিনী। থানা ও পুলিশ বিভাগের ৮০ ভাগই পাকিস্তানিরা ধ্বংস করেছিল। সেগুলো পুনর্গঠন করা হয়। যত দূর জানি, তার ব্যক্তি ইমেজে তিনি ইরান থেকে বিনা পয়সায় তেল আনেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাশিয়া থেকে ট্রাক্টর নিয়ে আসেন। রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণ করে তা ব্যবহার উপযোগী করেছিলেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হন। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তিনি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ তার আমলেই হয়। ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত করে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে সমবায় খামার স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর একটি বড় সাফল্য ছিলÑ স্বাধীনতার স্বল্পসময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেয়া। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আমাদের সংবিধানের মূলনীতি। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এই সংবিধানে সংরক্ষিত হয়েছিল। সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে তিনি একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছেঁটে ফেলা হয়। বর্তমানে তবে আনন্দের বিষয়, হাইকোর্টের এক রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দোষেগুণে মানুষ। শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও করেন কেউ কেউ। তবে এসব সমালোচনায় অপপ্রচারটাই বেশি ছিল। সেই সত্যই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। যে অবস্থান থেকে একটি সদ্যস্বাধীন দেশকে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেনÑ যদি বাধা না পেতেন, ষড়যন্ত্রের জালে না পড়তেন, শত্রুপক্ষের অরাজকতায় না পড়তেন, এতদিনে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের পর্যায়ে চলে যেত।
বঙ্গবন্ধুর ভালো-মন্দ দিকগুলো ইতিহাস মূল্যায়ন করবে। ইতিহাস চাপিয়ে দেয়ার বা জোর করে ধারণ করার বিষয় নয়। ’৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে নানা অপপ্রচার হয়েছিল। এ লক্ষ্যে সংবিধানেও হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে মিথ্যা তথ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ইতিহাস তার নিজের গতিতে চলেছে ও চলছে। ইতিহাসই জনক মুজিবের অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই দেশ যত দিন টিকে থাকবে, বাঙালি জাতি যত দিন থাকবে তত দিন বঙ্গবন্ধুও মানুষের হৃদয়ে থাকবেন। কারণ তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, বাংলাদেশ নামক দেশটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
লেখক : সভাপতি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি