সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
জেলার নাম গোপালগঞ্জ, গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। এই গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম, বাংলার বীর সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করেছিলেন সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে ছিলেন তৎকালীন সাত কোটি মানুষের স্বাধীন বাংলার স্বপ্নপ্রদর্শক। খোকা নামের দুরন্ত ছেলেটি যে একদিন বাঙালির মুক্তি সনদ রচনা করবেন হয়তো কেউ তা তার শৈশবে জানত না।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি সংবর্ধনা দেয়। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মানুষ গগনবিদারী স্লোগান এবং করতালির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়। ওই সভাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সাইফুদ্দিন মানিক বলেন, গুজব শোনা যাচ্ছেÑ শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে আইয়ুব খান স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ধ্বংস করতে চায়।
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বাংলার মানুষের সাথে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের প্রশ্নে আপস করিনি। আপস করে ক্ষমতায় যাবো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বার্থে কারো সাথে কোনো সময় আপস করেননি। সময়টি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাইক্লোন ও হারিকেনের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পালতোলা তরণীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কাজটি করতে পেরেছিলেন। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো না কোনো কাণ্ডারি আবির্ভূত হন। পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। তার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা। তার উৎসাহ শুধুু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তার চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র পৃথিবীও স্বীকার করে।
যে মানুষটি দীর্ঘ দিনের সাংগঠনিক কার্যক্রম, ত্যাগ, আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে মুক্তি সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়ে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাধীন স্বদেশ এনে দিতে পারেন, সর্বশ্রেষ্ঠের শিরোপা তারই প্রাপ্য। বিশ্বের মানচিত্রে আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্রষ্টা হওয়ার কৃতিত্বের পাশে যেকোনো মহৎ মানুষের মহান কীর্তি ম্লান হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এ কাজটি করেছেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি গণ-আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। দুর্বার জাতীয় ঐক্য অর্জনের সংকল্পকে তুঙ্গে নিয়ে যান। এটাকে বজ্রকঠোর করে তোলেন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত।
পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী কর্তৃক গণহত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন দেশের মানুষের মুকুটবিহীন সম্রাট; সমগ্র জাতির ম্যান্ডেট পাওয়া সর্বক্ষমতাপ্রাপ্ত একক প্রতিনিধি। মুজিবের প্রতিটি নির্দেশ তখন সব বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে সার্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। তার বিখ্যাত ভাষণে জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশবাসীকে তিনি ডাক দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গেলেই ১৯৭১ সালের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিমের মন বেদনাহত হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি এবং তার রাজনৈতিক গুরু ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী-মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। মওলানা ভাসানীর অত্যন্ত যোগ্য উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধু। তাই গুরু হয়েও শিষ্যকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার আগে এবং পরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রায় সমার্থক বঙ্গবন্ধুর নামের।
‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ একটি বিখ্যাত সঙ্গীত। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সেই গান শুনতাম। সেই ফুল হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই ফুল কী? গণতন্ত্র। সেই ফুল কী? বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাংলাদেশকে যেমনি উদ্বেলিত করেছিল, তেমনি সেনাবাহিনীতে বাঙালি যারা চাকরি করতাম, আমাদেরও উদ্বেলিত করেছিল। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই কথা ৯ মাস যাবৎ কানে বেজেছে। তার যোগ্য সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং বঙ্গবীর ওসমানীর সামরিক নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। স্বাধীনতায় তার অবদান অনেকেই খাটো করে দেখে। বলে যে, তিনি তো বন্দী ছিলেন। আমি বলতে চাইÑ বন্দী বঙ্গবন্ধু কোনোভাবেই মুক্ত বঙ্গবন্ধু থেকে কম ছিলেন না, বরং মুক্ত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বন্দী বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার নেপথ্যে বড় অবদান রেখেছেন। আসলে পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তার নামে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালির মনে, হৃদয়ে প্রেরণা জোগাচ্ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’র নামটি।
ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল আস্থার কারণে দেশের মানুষ তার প্রতিটি নির্দেশ আক্ষরিকভাবে পালন করেছে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়েছে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গ্রামেগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, যুদ্ধাহতদের সেবা করেছে, গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করেছে এবং তাদের শত্রুর ঘাঁটির সন্ধান দিয়েছে।
আমাদের ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জাতি সে দিন রাষ্ট্রপতির চেয়ার খালি রেখেছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যই। বঙ্গবন্ধুবিহীন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ কল্পনা করা অসম্ভব ও অর্থহীন।
একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে দেখব? তাকে দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে; তাকে দেখেছি সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তায়, সামরিক বাহিনীর স্পর্শকাতরতায় এবং তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকদের অনুভূতির প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও আবেগপ্রবণ হিসেবে। তিনি আপন সন্তানের মতো আমাদের তরুণদের কাছে টেনে নিয়ে আদর করেছিলেন। তাই যেদিন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সেই অশুভ সকালে ঘাতকেরা তাকে হত্যা করল, সে দিন সমগ্র দেশবাসীর সাথে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর তরুণ প্রজন্ম মর্মাহত এবং শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর হাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম এবং গড়ে ওঠা শুরু। তিনি যদি সে দিন সেই প্রয়োজন অনুভব না করতেন তাহলে এই সেনাবাহিনী অন্য রূপ ধারণ করত। ছোট্ট একটা সমালোচনা আছে যে, বঙ্গবন্ধু জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। একজন সরকারপ্রধানের কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হতে পারে। কিন্তু তার মর্ম বুঝতে হবে। মর্ম হলোÑ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন আমাদের একটি স্বাধীন সুন্দর, দক্ষ সেনাবাহিনী যাদের ভিত্তি মুক্তিযোদ্ধারা এবং তিনি সেই কথা রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও তখনো বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা দানকারী মূল শক্তি। সফল মুক্তিযুদ্ধ শেষে মুক্ত স্বদেশ ফিরে এসে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন দেশ পুনর্গঠনের কাজে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির সামনে স্তূপীকৃত পর্বতসমান সমস্যার সমাধানে তিনি অসমান্য দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বড় সাফল্য স্বাধীনতার ৯ মাসের মধ্যেই দেশকে একটি চমৎকার আধুনিক সংবিধান উপহার দেয়া। সংবিধান প্রণয়নে তার ধ্যানধারণা ও নির্দেশনা যে অমূল্য ভূমিকা পালন করেছিল তা সর্বজনবিদিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনসাধারণ, সব সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সবাই একত্র হয়ে এক জাতিতে পরিণত হয়েছিল যেটা আগে কখনো হয়নি।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পথ সুগম করার ‘অপরাধে’ পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব জনমতের ভয়ে তারা সেই দণ্ড কার্যকর করতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই শেখ মুজিবকে তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি আজ সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার জীবন ও কর্মের স্মৃতি জ্যোতির্ময় শিখার মতো অন্তহীন প্রেরণার উৎস হয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি