সালেম সুলেরী
-
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণটি একদিকে ঐতিহাসিক। অন্য দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বক্তব্য দেয়ার ভঙ্গিটিও সুবিখ্যাত। এই ভঙ্গিটি আমি প্রথম অবলোকন করি ১৯৭০-এ। ২৩ অক্টোবরের সূর্যক্লান্ত শেষ বিকেলে। পূর্ব-পাকিস্তান নামীয় ভূখণ্ডের বিদায়পূর্ব বছরে। সেবারই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখা। প্রথম দর্শনের সেই স্মৃতিটি ঘটনাবহুল। কায়ক্লেশে এলেন তিনি আমাদের সবুজ মফস্বলে। ভারতঘেঁষা বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারীর ডোমারে। বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে সিও ডেভেলপমেন্টের মাঠে। বহর নিয়ে তিনি বেরিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারে।
সামরিক সরকারের অধীনে প্রাদেশিক ও জাতীয় নির্বাচন। পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে সারা পাকিস্তানে ভোটের বাতাবরণ। আমাদের এলাকার প্রার্থী ছিলেন একজন নামকরা ছাত্রনেতা। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি আবদুর রউফ। সভা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দু’জন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা পঞ্চগড়ের অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। এ ছাড়া স্থানীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সরকার মাহবুব আলম। আমার অগ্রজ এবং সুবক্তা, কবি ও গীতিকার। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিয়াস-তাতানো ছাত্র। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলাম মেজদার হাত ধরে। মেজদা মনজুরুল আলম/দিলু তখন পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। পরে পেশাজীবনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী।
তো প্রথমে খুব খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। বঙ্গবন্ধুর আসার কথা দুপুর ১২টায়। বিকেল ৫টাতেও হদিস নেই। থাকবেইবা কী করে। রাস্তায় রাস্তায় অনির্ধারিত মঞ্চ। পল্লীপথÑ লোকে লোকারণ্য। ৭-২৩ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মানুষ ভোট দেবে। কেনো নৌকায় ভোট দেবে তা জানতে চায়। এ ছাড়া ‘মজিবর’কে এক পলক দেখার তুমুল প্রতিযোগিতা। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু উপাধিটি তখনো ব্যাপক প্রচারণা পায়নি। বেশির ভাগ মানুষ ‘মজিবর’ বলতেন।
অনেক বিলম্ব, তবুও সভায় অগুনতি মানুষ। কিছু দিন আগে মওলানা ভাসানীও এসেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গড়ে ‘মজলুম জননেতা’ খ্যাতি পান। নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সেই জোট বিজয় পেয়েছিল। আওয়ামী লীগে যুগ্ম থেকে পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মহামুজিব। পরে সভাপতি মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। সমমনাদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গড়েন। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন তিনি। ১৯৭০-এ নির্বাচন-বিরোধী ছিল ‘ভাসানী ন্যাপ’। তিনি জনসভায় বলেছিলেন, ‘ভোট করে কোনো লাভ হবে না। ওই পাকিস্তানিরা বাঙালিকে ক্ষমতা দেবে না। ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো।’
মওলানা ভাসানীর আহ্বান নিয়েও এলাকায় অনেক প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু আসা অবধি বক্তব্য দেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। বেশির ভাগ সময় মাইক্রোফোন ছিল অ্যাডভোকেট সিরাজুলের হাতে। বললেন, মওলানা মুজিবরকে অনেক ভালোবাসেন। তিনি চান না আওয়ামী লীগের ভোট ভাগাভাগি হোক। জনগণের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে।
গোপন কথা হলোÑ তিনি সেটাই চান। কারণ বিশ্ব তাকিয়ে আছে ভোটের ফলাফলের দিকে। এরপর সমাবেশকে ধরে রাখার জন্য আঞ্চলিক শ্লোক শোনান। বলেন, ‘শোনেন বাহেÑ যার কথার নাই ঠিক, তায় করে পলিটিক্স। তার মধ্যে যে শেয়ান (শেয়ানা), তায় হইল পলিটিশিয়ান।’ আত্মসমালোচনামূলক এমন বয়ান মানুষ উপভোগ করছিল।
অবশেষে অপেক্ষার পালা অতিক্রান্ত হলো! সন্ধ্যে পোনে ৬টায় সদলবলে রাজরূপে বঙ্গবন্ধু এলেন। থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুতফুল হকের সভাপতিত্বে শুরু হলো সভা। মেঘেরাও যেন হালকা বৃষ্টিরূপে মাঠে নেমে এলো। কিন্তু বৃষ্টি-কষ্টে কেউ আসন ছেড়ে পালাল না। সবার আগ্রহী চোখ স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর দিকে। খুব সহসাই তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, এবারের নির্বাচন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। অধিকারহারা বাঙালিকে এই ভোটযুদ্ধে জিততেই হবে। একটা ভোট যেন বাইরে না যায়। তিনি আবদুর রউফকে সামনে নিয়ে দাঁড় করালেন। বললেন, এই আমাদের নৌকা মার্কার প্রার্থী। আপনাদের সন্তান, আমার একান্ত প্রিয়ভাজন। ডোমার-ডিমলার এমপি ও এমএনএÑ দুই পদেই প্রার্থী। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করবে। আপনারা সবাই হাত তুলে সমর্থন জানান। জনগণও বিপুল উৎসাহে দু’হাত তুলল। বঙ্গবন্ধু আবার বক্তৃতার ভঙ্গিমায় সোচ্চার হলেন। বললেন, ভোট নিয়ে কারসাজির চেষ্টা চলছে। আপনারা কমিটি করে পাহারা দেবেন। রেজাল্ট নিয়ে ছল-চালাকি করলে কালো হাত গুঁড়িয়ে দেবেন। বিজয় আমাদের আসবেই। এই এলাকাতেও বিজয় ঠেকানো যাবে না। উপস্থিত সবাইকে মোবারকবাদ। জয় বাংলা।
জাদুকণ্ঠের প্রত্যাশিত বক্তব্য ওই পর্যন্তই। সে দিন লক্ষ করলাম বঙ্গবন্ধুর তর্জনীতে কত শক্তি। আমরা শৈশবে তীর ধনুক দিয়ে খেলতাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা ছিলাম খুদে তীরন্দাজ। বঙ্গবন্ধুর উচ্চকিত তর্জনীতে তীরের প্রতিচ্ছায়া লক্ষ করলাম। সেই জাগরিত স্মৃতির ওপরই দাঁড় করি কাব্য-কাঠামো। শিরোনাম দেই ‘তর্জনীর তীর’। বঙ্গবন্ধু পরেছিলেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। উপরে কালো ক’টি বা ‘ওয়াচকোট’। যা পরবর্তীতে ‘মুজিব কোট’ আখ্যা পায়। আমি পুরো পোশাক-প্যাকেজকে সাদাকালো পৃথিবীর প্রতীক ভাবি। সতত আন্দোলিত পুরো দেহকে বলি ‘ধনুক শরীর’। আর উঁচু করা অনামিকাকে ‘তর্জনীর তীর’। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতাটি প্রথম ছাপা হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। এরপর দেশে-বিদেশে অসংখ্যবার পুনঃমুদ্রণ। আবৃত্তিও হয়েছে অনেকের নিবিষ্ট কণ্ঠে। বিষয়টি অনুকরণ করে অনেকেই আরো কবিতা চয়ন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০-এর ১৭ মার্চ। বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। মধুমতির উপনদী বাইগার-এর পাশে। টাইগার বা ব্যাঘ্র প্রকৃতির উদার মানুষ তিনি। ১৯৪৭-এর পাকিস্তান গড়ার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। বাঙালি অধ্যুষিত পূর্বপাকিস্তানকে তিনি ‘বাঙলাদেশ’ ডাকতেন। ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধিকার চেতনাকে উজ্জীবিত করেন। একজীবনে কারাভোগ করেছেন চার হাজার ৬৮২ দিন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিজ দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানের বিরাজিত শাসন ক্ষমতা পায়নি। এ জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র বিরোধ। রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, সংগ্রামÑ উদ্যত উদ্দাম। তারই বহুমাত্রিক বহিঃপ্রকাশ : ‘তর্জনীর তীর’। যেন শক্তিমত্তায় ঋদ্ধ দেহ-মনÑ অধিকাংশ বাঙালির।
যুদ্ধকালে পাকিস্তানের আদালতে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ‘মুজিব’ ছিলেন সর্বাধিক উচ্চারিত নাম। গানও তৈরি হয়েছিল এই মহানায়কের নামে। আমি সেই অগ্নিসোপান উত্থানপর্বের অনুজ সাক্ষী। পরবর্তী ইতিহাস বিজয় ও শোকের। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় প্রাপ্তি। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। প্রথমে দলীয় ও ১৯৭৫-এ বাকশাল সরকার গঠন। প্রধানমন্ত্রী থেকে পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ। ক্ষমতায় থেকেও ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে প্রাণ হারালেন। কী নির্মম সেই বিষণœ-বিদায়-ব্যভিচার। রাজনীতির কূটচালে ভরা সুখী বাংলার প্রাঙ্গণ। অধিকাংশকাল স্বাধীনতা আছে, স্বনির্ভরতা নেই। প্রত্যাশা অনেক, ফলাফল সামান্যই। সামাজিক প্রশান্তি দূরাগত। মানুষের বুকে বুকে নীরব প্রতিবাদের ঢেউ। দারিদ্র্য-দুর্নীতি-দুরাচারÑ দলিত দুর্দশা দমনে দোলা দিচ্ছে দাবানল। অপীড়িতদের হৃদয়-হস্ত-আঙ্গুলে বঙ্গবন্ধুর সাহসী প্রতীক! যেন নীরবে ফুঁসছে সেই রুদ্র-প্রতিবাদ : ‘তর্জনীর তীর’।
তর্জনীর তীর
সালেম সুলেরী
ধনুক শরীরে তার কেঁপে ওঠে তীক্ষè তর্জনীর তীর।
পড়ন্ত রোদ্দুর গায়ে মেখে তিনি ঘোষণা করেন
আগামী দিনের লাল ইতিহাসÑ
আর কোনো শক্তি নয়,
আগামী সূর্যের আড়মোড়া ভেঙে দিয়ে
দেখবে নিজেরা সব আলোর নাচন পতাকায় পতাকায়।
নতুন প্রজন্ম তার অভিজ্ঞতার খাতায়
বারুদ মাখানো ক্লান্তি নিয়ে ঝুঁকে পড়ে ফেলল নিঃশ্বাস।
বিশ্বাস করেছি যাকেÑ তাকে রেখেছি প্রাণের প্রহরায়।
তাকে ছুঁয়েছি কৈশোরে, ডোমারের গ্রামীণ জনসভায়।
তাঁকে মঞ্চে রেখে উনিশশত সত্তরে, সূর্য ডুবে গেলা
যেন বাংলাদেশ হয়ে জেগে উঠবার জন্যে...।
তাকে দেখেছি তখন
হন্যে হয়ে তাকাতে, পরতে পাঞ্জাবিতে
কালো হাতাহীন কোট,
তারপর-
সাদাকালোর মিশ্রণে তিনি হয়ে গেলেন তৃতীয় বিশ্ব।
তিল ধারণের জায়গায় দাঁড়িয়ে মেজদার হাতে হাত।
বৃষ্টিস্নাত সে সেঁজুতি সন্ধ্যা, সুদিন-সন্ধান।
গায়ের চাদরে মাথা ঢাকলেও সর্বাঙ্গ ভিজল।
আমি ছাতা বলে চিৎকার করার আগেই
জাদুকরের ভঙ্গিতে অদ্ভুত মুদ্রায় কাঁপালেন ঠোঁট।
আমি তোমাদেরই লোকÑ বলতেই মঞ্চের দুরন্ত সামিয়ানা
যেন বৃষ্টির বিপক্ষে এক বৃহত্তর ছাতা, ঢাকল সমস্ত মাঠ।
বিতর্ক যুগের পর কৈশোরের হাফপ্যান্ট নিয়েছে বিদায়।
তারুণ্যের কালো চোখে বৃষ্টি এবং বিদ্যুৎ-বিদ্রোহ বিকম্পন!
সবপেয়েছিল দেশে খুঁজে ফিরি
বিজয়ী জাতির পরাজিত নেতাদের মৃত্যুর দলিল!
আর খুঁজি গণতন্ত্র, ঘাতক নিরোধে রক্তচক্ষু বাঙালির,
খুঁজি সেই ধনুক শরীরে কেঁপে ওঠা তীক্ষè তর্জনীর তীর। হ