ড. এ কে আবদুল মোমেন
‘সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালোবাসা আছে, শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি’—নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতো আমি সারা দিন, এই স্বাধীনতার মাসে, সারা বছর ধরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলতে এসেছি। বলতে এসেছি একটি স্বাধীন দেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে একজন নেতার সারা জীবনের ত্যাগের কথা, বারবার নির্যাতিত হয়ে অবিরত লড়াই-সংগ্রামের কথা।
বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির শৃঙ্খলমুক্তি ও মানবকল্যাণই ছিল যাঁর ব্রত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধু নামটি অবিচ্ছেদ্য। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বর্গসুখের ভাবনাটি স্থান পেয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনায়, যাঁর লড়াই ও সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাঙালি আজ একটি গর্বিত জাতি। বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, বিশ্বদরবারে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। ১৭ মার্চ মহান এ কালপুরুষের জন্মদিন।
মানবিক গুণাবলির অনন্য আধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন। তবে গুণাবলির অধ্যায়ে সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে শিশুদের প্রতি দরদ। স্বাধীনতার পর আমি তখন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করছি। ১৯৭৩ সালে সরকারি একটা কাজে গেলাম ইংল্যান্ডে। আমার এক ডাক্তার আপা আমাকে কিছু দরকারি জিনিসপত্র আনতে বললেন। এর মধ্যে ছিল শিশুদের গুঁড়ো দুধ, পানি খাওয়ার বোতল, ফিডার, তেলসহ আরো কিছু। বাংলাদেশে সে সময় ব্লেডের খুব অভাব ছিল। একটা ব্লেডের দাম ছিল ৫ টাকা। কেনাকাটার তালিকায় নিজের জন্য এক প্যাকেট ব্লেড, গুঁড়ো দুধ ও দুধের বোতল। কিন্তু ইংল্যান্ডে এত ব্যস্ত ছিলাম যে দোকানে গিয়ে কেনাকাটার সময় আর করে উঠতে পারিনি। সে সময় পরিচিত এক গার্বনারকে (রেস্তোরাঁর মালিক) এ তিনটি পণ্য কিনে আনতে বললাম। তিনি খুশি হয়ে শপিংয়ে চলে গেলেন।
কিন্তু তার বাজারের বিরাট থলে দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। বলেছিলাম এক প্যাকেট ব্লেড আনতে। তিনি নিয়ে এসেছেন ১৫ প্যাকেট ব্লেড। সে সময়ে ৪ টাকা ৭৬ পয়সা সমান ছিল ১ ডলার। আর ১৮ টাকা ছিল ১ পাউন্ডের সমান। আমি তাকে আনতে বলেছিলাম একটি গুঁড়ো দুধের প্যাকেট আর দুটি প্লাস্টিকের বোতল। তিনি নিয়ে এলেন ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্লাস্টিক বোতল। আর কয়েকটি গুঁড়ো দুধের প্যাকেট। সরকার তখন আমাদের খুব কম টাকা দিত। ২৫ পাউন্ড ছিল আমাদের সফরের সম্মানী। এত পণ্য দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, এত টাকা আমি কীভাবে দেব? তখন তিনি স্মিত হেসে জানালেন, একেকটি বোতলের দাম ৬ প্যাঞ্চ। আর ১৫টি ব্লেডের দাম ১ পাউন্ড। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত সস্তা! ভদ্রলোক তখন আমাকে বললেন, আমরা দেশে পণ্য নিয়ে যেতে পারি না। এগুলো নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দিলে আমরা লাগেজ ভর্তি করে এসব পণ্য দেশে নিয়ে যেতে পারি। এগুলো দেশে কম মূল্যে বিক্রি করলে প্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান বাড়বে। এতে দেশের মূল্যস্ফীতি কমবে, দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় ও মানসম্মত পণ্য পাবে। এর মাধ্যমে যে লাভ হবে, তাতে আমাদের যাতায়াতের খরচও উঠে যাবে। ফলে সবারই লাভ। লন্ডন প্রবাসী এ বাঙালিরা দেশ গঠনে অনেক আগ্রহ দেখান। তাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ বিমান চালু করা হয়। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে তারা দেশের অর্থনীতির ভিতও গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেন। দেশে বিনিয়োগ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনেও তাদের মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা যায়। লাগেজ ভর্তি করে পণ্য আনার সুযোগটি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। কেননা সে সময় বঙ্গবন্ধুর সরকার বিভিন্ন দেশে লোকজন পাঠাচ্ছে বিদেশী ঋণ ও অনুদান সংগ্রহের জন্য। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের বড় একটা সুযোগ আমরা হাতছাড়া করতে চাইনি।
দেশে ফিরে এ বিষয়ে আমি একটা প্রস্তাবনা তৈরি করি। ১৯৭৩ সালে প্রস্তাবনাটা আমি সে সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী এমআর সিদ্দিকীর কাছে উত্থাপন করি। তিনি প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলেন। ১৯৭৪ সালে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন রাজশাহীর এএইচএম কামরুজ্জামান। আমরা তাকে হেনা ভাই বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন আবার আমার প্রথম বস দেওয়ান ফরিদ গাজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি দেওয়ান ফরিদ গাজীকে বললাম, আপনি আপনার বন্ধুকে অনুরোধ করেন প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য। তার কাছে প্রস্তাবনা গেলে আমাকে ডেকে বললেন, বলো কীভাবে কী করলে প্রস্তাবটি পাস করা যাবে। আমি তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। তার হাতের লেখা ছিল চমত্কার, সঙ্গে সঙ্গে কলম নিয়ে তিনি সুন্দর করে ঘুটঘুট করে ইতিবাচক মত দিয়ে নোট দিয়ে দিলেন। পরে সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করা হলো। কিন্তু বাদ সাধলেন সে সময়ের বাণিজ্য সচিব নুরুল ইসলাম। তিনি বললেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে কত টাকার সম্পদ দেশে আসবে তা অস্পষ্ট। যদিও সে সময়ে ধারণা করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে দেড় কোটি টাকার সম্পদ আসবে। তিনি আরো বললেন, এর মাধ্যমে কেবল সিলেট অঞ্চলের জনগণ উপকৃত হবে। কারণ তখন অধিকাংশ লন্ডনি ছিলেন সিলেট অঞ্চলের। সে সময়ে আসলে প্রবাসী বলতে কেবল সিলেট অঞ্চলের লোকজনকেই বোঝানো হতো। কেননা লন্ডন তো বটেই, অন্যান্য দেশেও প্রচুর পরিমাণে সিলেট অঞ্চলের লোকজন থাকত। কী আর করা! তিনি প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলেন।
আমরা মন খারাপ করে বসে আছি। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর কক্ষে তখনো সিলেট অঞ্চলের কয়েকজন সংসদ সদস্য বসে। ভাবছেন, কী করা যায়। তখন কেউ একজন বলে উঠলেন, গাজী সাহেব, চলেন বিষয়টি নিয়ে নেতার কাছে যাই। নেতা বলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝানো হলো।
আমরা কাগজপত্রসহকারে দলবল নিয়ে চলে গেলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। বিকালের এ সময়ে তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে আলাপ করছিলেন আর পুকুরে মাছের খাবার ছিটাচ্ছিলেন।
আমাদের দেখে তিনি বলে উঠলেন, দেওয়ান সাহেব, কী খবর! দলবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। সে সময়ে প্রতি ছয় মাস পর রেডিও-টিভি মারফতে বাণিজ্যনীতি ঘোষণা করা হতো। নীতি ঘোষণার তখনো দুদিন বাকি। দেওয়ান ফরিদ গাজী বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরতে বললেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমাদের দেশে গুঁড়ো দুধের খুব অভাব। গরুর দুধের জোগানও সীমিত। অথচ শিশুরা দুধের অভাবে কষ্টে ভুগছে। এর মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে আমরা সহজেই গুঁড়ো দুধ আনতে পারব। আমরা বলতে প্রবাসীরা নিজেদের টাকায় নিয়ে আসবে। এতে আমাদের নিজস্ব কোনো খরচ হবে না। এর মাধ্যমে শিশুরাও গুঁড়ো দুধ পাবে।
বঙ্গবন্ধু শুনে আঁতকে উঠলেন। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন, কী বলো? শিশুদের খাবারও আটকে দিয়েছে? কেন হবে না এটা? তখনই বাণিজ্য সচিবকে ডাকা হলো। সচিব মহোদয়কে তিনি নির্দেশ দিলেন এটার অনুমোদন দিয়ে দিতে। বললেন, আমাদের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের মেধার বিকাশ দরকার। ঠিকঠাক খাবারদাবার দরকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নানা সংকট নিয়ে দেশ চালাতে হচ্ছে। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে যদি শিশুদের জন্য খাবারসহ প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য আসে, তাতে মন্দ কী! সে সময়ে ওয়েজ আর্নার স্মিম চালু হলো। এর মাধ্যমে চারটি পণ্য আনার অনুমোদন পাওয়া গেল। শিশুবিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্তে তাঁর সায় ছিল সবসময়। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এ মনোভাব ছিল ছোটবেলা থেকেই।
বঙ্গবন্ধু সারা জীবনে দুটি বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আর মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য পথপ্রদর্শক। সারা জীবনই ন্যায্য অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। স্কুলের ছাত্র অবস্থায়ও তিনি আন্দোলন করেছেন। মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে তিনি ভীষণ আনন্দ পেতেন।
কিশোরকালেই ব্যক্তিত্বের পূর্বাভাস ফুটে ওঠে মানবচরিত্রে। খোকা বাবু বা শেখ মুজিবের চরিত্রেও ছিল তেমনই এক মানবিক অবয়ব। আদরের খোকা বাবু তখন কিশোর, থাকেন গোপালগঞ্জ জেলা শহরে। একবার স্কুল ছুটিতে গ্রামে গেলেন। সে বছর বেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছিল। মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামে গিয়ে তিনি গ্রামবাসী কৃষকদের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখলেন, কারো বাড়িতে খাবার নেই। ক্ষুধার্ত মুখগুলো দেখে কষ্ট পেলেন। ছুটিতে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল, ডাঙ্গুলি বা বদন খেলে সময় কাটাবেন, বনে-বাদাড়ে ঘুরে পাখির বাচ্চা দেখবেন, ফলমূল পেড়ে খাবেন। তা আর হলো কই! কৃষকদের সন্তানদের অসহায় অবস্থা দেখে কচি মনটা কেঁদে উঠল। না খেয়ে শিশুদের মুখগুলো শুকনো হয়ে গেছে। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিলেন। পুরো গ্রাম ঘুরে একটা হিসাব কষলেন, কত পরিবার অসহায়-বিপর্যস্ত। এরপর ছুটে গেলেন বাড়িতে। বিপত্তি বাধল। বাড়িতে বাবা নেই। চোখে তখনো ক্ষুধার্ত শিশুদের করুণ চাহনি। অপেক্ষা আর সইল না। তিনি বাড়ির গোলা থেকে ধান-চাল বের করলেন। বস্তা মাথায় নিয়ে ছুটলেন সেই ক্ষুধার্ত কৃষকদের বাড়ি বাড়ি। চাল-ডাল বিতরণ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে এলেন। ততক্ষণে ফিরে এসেছেন বাবাও। সব শুনে বাবা কিছুই বললেন না। বরং খুশিই হলেন, উৎসাহ দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কচি মনে কিশোর বয়সেই মানবপ্রেমের পূর্ণ পরস্ফুিটন ঘটেছিল। তাই তো ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।
শিশুকাল থেকেই মুজিব ছিলেন ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের। তাঁর ভয়-ভীতি আদৌ ছিল না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার অভ্যাস থাকায় কারো সামনেই তিনি কথা বলতে ভয় পেতেন না। প্রধান শিক্ষক গিরীশ বাবু কিশোর মুজিবের সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার গুণেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর আচরণে কিছুটা অবাক হলেও অন্য গুণের সঙ্গে সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা ও দৃপ্ত বলিষ্ঠতার জন্যই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই শুধু প্রধান শিক্ষককেই নয়, সবাইকেই জয় করে নিলেন। পরিচিত হয়ে উঠলেন সহপাঠী ও বয়ঃকনিষ্ঠদের ‘মুজিব ভাই’ রূপে। স্কুলে পড়া অবস্থায় তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে।
হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিষ্টি কথা, অন্তরঙ্গ ব্যবহার ও খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের কারণে অল্পদিনেই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবারই প্রিয় হয়ে উঠলেন মুজিব। স্কুলের যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁর থাকত সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি অনেক সামাজিক কাজেও মুজিব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। যেকোনো ধরনের কাজেই মুজিব এগিয়ে গেলে অন্য ছাত্ররাও তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যেত সেই কাজে। শৈশবকাল থেকেই মুজিবের খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল খেলায় তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ভলিবল খেলায় তাঁর বেশ আগ্রহ দেখা যেত। গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ‘ব্রতচারী নৃত্যে’র প্রতি তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।
পূর্ণ বয়স হলে তাঁর মধ্যে যে মহানুভবতা, ঔদার্য, সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ, সৎ সাহস, মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠচিত্তে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজের যেকোনো স্তর ও পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা প্রভৃতি গুণাবলি দেখা যায়, শৈশবেই তার প্রকাশ ঘটে। ‘উঠন্ত মূলো পত্তনেই চেনা যায়’—এ প্রবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয় মুজিবের জীবনে। এ বিষয়ের সঙ্গে ইংরেজি প্রবাদবাক্য ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ খুবই প্রাসঙ্গিক।
সম্ভ্রান্ত বংশের উত্তরাধিকার সূত্রেই সমাজকল্যাণের ব্রত পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাড়িতে আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, সওগাতসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা রাখা হতো। এসব পত্রিকা আর বই-পুস্তকের কল্যাণে কিশোর বয়সেই তাঁর সমসাময়িক দুনিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা জন্মে। সেই বয়সেই এলাকার অসহায় ও দুস্থদের উন্নয়ন ভাবনা তাঁর মাথায় জেঁকে বসল। সমাজের অমানবিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যে মানুষগুলোর দিনাতিপাত হচ্ছিল, তিনি তাদের সহায়তায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। সমাজের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে পেছনে ফেলে দিনবদলের দৃঢ় সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। সমাজবদলের যুদ্ধটাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য, যা জীবনযুদ্ধের চেয়েও বড় ও মহৎ। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন ঘটনা। গ্রামের ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টির চাল সংগ্রহ করলেন। বিক্রীত অর্থ ব্যয় করলেন অসহায় ও গরিব পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার পেছনে। সে সময়েই কিশোর মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার লুক্কায়িত নেতৃত্বের গুণাবলির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
কিশোর বয়সে সহপাঠী আবদুল মালেককে স্থানীয় হিন্দুরা ধরে নিয়ে মারধর করে। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন। অন্য বন্ধুদের নিয়ে মালেককে আটক অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ আসে গ্রেফতার করতে। কাছের জনেরা এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও তাঁকে আড়ালে লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দেন। তিনি সব অবজ্ঞা করেন। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন। সাজানো মামলা আর মিথ্যে ঘটনা দিয়ে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন। পরবর্তীকালে অসংখ্যবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কেটেছে কারাগারের অন্ধ কুঠিতে। এভাবে ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি প্রত্যক্ষ ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পেত না। এ জনপ্রিয়তা ও একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তাঁর একটি চারিত্রিক বিজয়।
পরবর্তী সারা জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল কৃষকদের মুক্তি, সাধারণ মানুষের পেটপুরে ডাল-ভাত খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতের আন্দোলন। দেশের স্বাবলম্বিতা আর অর্থনৈতিক মুক্তির জাগরণ। তিনি মনে-প্রাণে এ বিষয়গুলো ধারণ করতেন। তাঁর কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা, রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও প্রাধান্য পেয়েছে গণমানুষের অধিকার। এজন্য তাঁকে শুরু থেকেই ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলন করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে দেয়। আর এর ২৫ বছর পর তিনি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিজয়গাথা অর্জন করে ‘অনারারি ডক্টরেট অব ল’ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে দেশ বিভক্তি ঘটে। এতে বাংলাদেশ অংশের ভাগ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের অশনিসংকেত কেবল তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় শাসিত সময়ের স্রোতের সঙ্গে সবার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেই উপলব্ধির বিস্তৃতি ঘটে। সবার সে উপলব্ধি নিজের চেতনায় মিশিয়ে পরবর্তীকালে স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বতন্ত্র চেতনার বাস্তবায়ন ঘটে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া ছিল বাংলার গণমানুষকে ঘিরে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা—প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন এ দেশের জনগণের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠী ও সহযোগী শক্তি বরাবর অমানবিক আচরণ করে আসছে। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি আদায় সাময়িক সমাধান এনে দিতে পারে। স্থায়ী সমাধান সম্ভব একমাত্র ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বা স্বাধিকার আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ‘ছয় দফা’ ও ‘পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন’ তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী যে গণসচেতনতা, জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা আপামর জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সময় আন্দোলন-সংগ্রামে কাটিয়েছেন। তাঁর প্রশাসনিক নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা সময়ের হিসাবে হয়তো কম, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে অনেক বেশি। সদ্য স্বাধীন দেশে বিদেশ থেকে ফিরেই ছয় মাসের মধ্যে তিনি ভারতীয় সেনা দেশে পাঠিয়ে দিলেন। ফিলিপাইনে এখনো আমেরিকান সেনারা ঘোরাফেরা করে। কয়েক দশক পার হয়ে গেলেও বিদেশী সেনামুক্ত হতে পারেনি জাপান। অথচ মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে বিদেশী সেনামুক্ত করার জন্য চরম সাহসের দরকার, যেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাঁর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জিত, অন্যান্য দেশের মতো বিপুল প্রাণহানি এখানে ঘটেনি। জাতির জনক হিসেবে স্বল্পদিনের মধ্যেই ৭৩টি দেশের স্বীকৃতি, সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতিসংঘেরও সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই। আমেরিকা, পাকিস্তান বা অন্য দেশগুলো যেখানে বছরের পর বছরে সংবিধান রচনা করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ১০ মাসের মধ্যে একটি উন্নত ও আদর্শ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি কার্যকর ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য শাসন ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন জাতির জনক। তিনি যথার্থই জাতির জনক।
একটি দেশের যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা তথ্য বা গাণিতিক হিসাব দিয়ে পরিসংখ্যান করা যায় না। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় বাস্তব কর্মসূচি হিসেবে দেদীপ্যমান। সে সময়ে তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি করে অনেক বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জীবনের পরতে পরতে রয়েছে সংগ্রাম। এ সংগ্রাম মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য। মানুষ যেন ঠিকমতো অধিকারগুলো বুঝে পায়, তার জন্য। কিন্তু অবিরত লড়ে যাওয়া, পরে স্বাধীন বাংলার প্রশাসক হিসেবে নতুন করে দেশ গঠনের প্রক্রিয়া—সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়। আর এত কিছুর মধ্যেও শিশুদের জন্য তাঁর মন কেঁদে ওঠে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে এক বছরব্যাপী কর্মসূচি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ কর্মসূচি উদযাপন করা হবে দেশে ও বিদেশে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য দুই বছরব্যাপী পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
২০২০ সালে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে। এর পরের বছরই ২০২১ সালে পালিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশের স্থপতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার পাশাপাশি তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়নে অর্জিত অগ্রগতির বিষয়ে বিশ্বজনীন আগ্রহের কথা বিবেচনা করে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশেও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও অর্জন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের অর্জন, অগ্রগতি, আগামীর প্রত্যাশা, কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হবে।
ইতিহাসের চাহিদা অনুযায়ী জনগণকে জাগিয়ে তুলে, জাগ্রত জনগণের গণবাণীকে সঠিক রূপে প্রতিফলিত করে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন ইতিহাসের নায়ক। বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক। তাই শিশু বয়স থেকেই দূরদর্শী এ নেতার জীবনী পড়া উচিত সব শিশুর। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ছড়িয়ে দেয়া উচিত সারা দেশে, বিশ্বের আনাচে-কানাচে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্লাসে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠ্যসূচি হিসেবে রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাহলে নতুন প্রজন্ম জানবে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস, দীক্ষা পাবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবনের, তাঁর অভিজ্ঞতার।
লেখক: মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার