আবদুল মান্নান
বাঙালি আর বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের কয়েকটি তারিখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ২৫ ও ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের বাঙালি নিধনপর্ব অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পিলখানা ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, যা পরদিন বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি কবি ও লেখক আহমেদ সেলিম তাঁর বই Blood Beaten Track-এ লিখেছেন, ‘একজন সাংবাদিক পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর টিক্কা খানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছিলেন?’ জবাবে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমার একজন অধীনস্থ অফিসার সেই রাতে আমার কাছে একটি তিন ব্যান্ডের রেডিও এনে বললেন, ‘স্যার শুনুন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঘোষণাটা শোনার পর আমার সামনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।’ (পৃষ্ঠা ৩২) যদিও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ১৬ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য বৈঠকে করছিলেন, তিনি এটি ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এটি বুঝতে পেরেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, আর তা হচ্ছে বিশ্বকে এটি বোঝানো নির্বাচনে বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুয়ায়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক, তা চেয়েছে কোনো ধরনের বিপ্লব করতে নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত দল বিপ্লব করে নয়, শান্তিপূর্ণভাবে সরকার গঠন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য তো ভিন্ন ছিল। তারা চেয়েছিল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের পাকিস্তান শাসন করার ইচ্ছাকে চিরতরে দমন করা। বৈঠক ছিল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার একটি অপকৌশল মাত্র।
২৪ মার্চই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল বাঙালি নিধনের জন্য পাকিস্তানের প্রস্তুতি শেষ। আহমেদ সেলিম লিখেছেন, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই দিন দেখা করতে আসেন। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ৩ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের পূর্বঘোষিত অধিবেশনে যোগ দিতে। সেই অধিবেশন বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও তিনি ঢাকায় রয়ে যান এবং ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে তাঁর সঙ্গে আলোচনাও করেন। ওয়ালি খান বঙ্গবন্ধুকে বলেন, তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ফেরত যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, তিনি যেন প্রথম ফ্লাইটেই ঢাকা ছেড়ে চলে যান। ওয়ালি খান তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, ‘আপনি কেন এত হতাশ’? উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, ‘গতকাল আমি বেলা ১২টা থেকে আজ সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমার মনে হয়েছে জেনারেলরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর।...আমাদের জন্য আপনি দোয়া করবেন। এরা আমাদের রক্ত চায়। সম্ভবত এটাই আমাদের শেষ দেখা।...আমি (ওয়ালি খান) তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) চোখের কোনায় অশ্রু দেখতে পাই। তিনি বেশ ভারাক্রান্ত ছিলেন’ (আাাহমেদ সেলিম)।
২৫ তারিখ রাত পর্যন্ত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাঁর দলের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল। সেই রাতে ঢাকার পরিস্থিতি ছিল বেশ থমথমে। সারা রাত ঢাকা শহরে ব্যারিকেড আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে সব শেষে বের হয়ে গিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। পথে ড. কামাল হোসেন গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। পরে তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, তাজউদ্দীনসহ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। তাঁরা ২৭ মার্চ ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া হয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে গিয়ে সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করা। সে সময় কুষ্টিয়ার মেহেরপুর সাবডিভিশনের এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা) এবং মাহবুব উদ্দিন আহমদ (এসপি মাহবুব নামে পরিচিত) ছিলেন ঝিনাইদহের সাবডিভিশন পুলিশ অফিসার। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ওই দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে সীমান্তের ওপারে পাঠান বিএসএফের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এবং ভারত সরকারের সঙ্গে, বিশেষ করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা যায় কি না তা যাচাই করার জন্য। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেদিনীপুর জেলা। তৌফিক-ই-এলাহী ও মাহবুব উদ্দিনের ভাগ্য ভালো, তাঁরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক গোলক মজুমদারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গোলক মজুমদারের ভূমিকা এককথায় অবিস্মরণীয়। তিনি দ্রুতগতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। যেখানে তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। অবশ্য ইন্দিরা গান্ধী এসব বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। দিল্লি যাত্রার আগে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম গোলক মজুমদারের হাতে পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত সব জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্যদের তালিকা হস্তান্তর করে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক জায়গায় সমবেত করেন, যা গোলক মজুমদার করতে পেরেছিলেন। যেহেতু সে সময় পশ্চিম বাংলায় নক্সালবাড়ী আন্দোলন নামে একটি মাওবাদী আন্দোলন চলছিল, সেহেতু ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। কারণ মাওবাদীরা গলাকাটা রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর চর বলে আখ্যায়িত করতেন। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন চীনের চেয়ারম্যান মাও জেদং তাদের চেয়ারম্যান। চীন তখন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের নেতাদের বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা করতে প্রস্তুত, তবে তা হতে হবে একটি বৈধ ও জনসমর্থিত সংগঠনের ওপর। তা না হলে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যাতে নকশালপন্থীরা লাভবান হবে।
তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম কলকাতা ফিরে দেখেন মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে পরিচালিত হবে, কারা তা করবেন সে সম্পর্কে একাধিক চিন্তাধারা এরই মধ্যে চালু হয়ে গেছে। কেউ বলছেন, একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করা হোক, আবার কোনো কোনো সেনা সদস্যের মত হচ্ছে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি সেনা কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হোক। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা এটা বুঝেছিলেন, তেমনটি হলে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক মহলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখা হবে, যেমনটি শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগাররা অথবা আফ্রিকার বাইয়াফ্রায় (নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে আন্দোলন) হয়েছিল। আরেকটি সম্ভাবনা ছিল আর তা হচ্ছে, এসব কাউন্সিল দল, উপদল ও কোন্দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি করা। নেতৃত্ব অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে এবং তাদের নিয়েই একটি যুদ্ধকালীন সরকার গঠিত হবে। এতে কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন হলেও বাস্তবতার খাতিরে তা মেনে নিয়েছিলেন। গোলক মজুমদার এরই মধ্যে কয়েকজন বাদে সব নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে একত্র করতে পেরেছিলেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সব গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম খসড়া করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (The Proclamation of Independence)। এই ঘোষণাপত্র শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন ও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের কথা উল্লেখ করে। কিভাবে পাকিস্তানে সামরিক শাসক সেই নির্বাচনের ফল বানচাল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন তা-ও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ-ও বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু এসব ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার কথাও বাদ যায়নি। ঘোষণায় পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, যেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সংবিধান রচনা করার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি, সে কারণেই তাঁরা সমবেত হয়েছেন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায্যতাকে ভিত্তি করে একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করতে। ঘোষণায় আরো উল্লেখ করা হয়, যত দিন পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণীত না হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্বও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রপতি হবেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সরকার গঠন করার একমাত্র এখতিয়ার ন্যস্ত থাকবে রাষ্ট্রপতির ওপর। ঘোষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয় যে এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বলবৎ হবে। ঘোষণাপত্রের শেষ ব্যাক্যে গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে রাতেই বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ও সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছিলেন। ১০ তারিখের ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের কাঠামো নির্মিত হয় এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং এ ঘোষণাটিই ছিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান, যা ১৯৭২ সালের ২৩ মে একটি সরকারি গেজেট দ্বারা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হুদার মতে, এই ঘোষণাপত্রই ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের সূচনাবিন্দু (Genesis, মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলা)। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও অনুমোদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ১৯৬৬ সালের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের যে দলিল (International Covenant on Civil and Political Rights) আছে তাতে বলা হয়েছে, একটি বৈধ সরকার গঠন করার অধিকার একমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতেই ন্যস্ত।
একটি সরকার সম্পূর্ণ বৈধতা পায় যখন সেই সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করে। সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বাংলাদেশের ভেতরে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার এক আম্রকুঞ্জে, প্রকাশ্যে দিবালোকে শখানেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকার জনগণের উপস্থিতিতে। ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননের যুদ্ধক্ষেত্র বৈদ্যনাথতলা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বাংলার যে সূর্য ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালে আরেক আম্রকাননে সেই সূর্য ১৭ এপ্রিল আবার উদয় হয়েছিল। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে চার সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল। সেই সরকার কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ও টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানকে সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (Chief of the government press department) নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় একটি গির্জার কর্মচারীরা। যেখানে দর্শকরা বসেছিলেন, বসার সেই টুলও গির্জা থেকে আনা হয়েছিল। এসপি মাহবুব কয়েকজন পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নিয়ে নবগঠিত সেই সরকারকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন এবং স্থানীয় জনগণ গেয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে। শপথ বাক্য পাঠের সময় উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সংক্ষিপ্ত অথচ এই ঐতিহাসিক কর্মসূচি চলাকালীন অনুষ্ঠানস্থলের নিরাপত্তার বিধান করেছিল স্থানীয় জনগণ ও গোলক মজুমদারের নির্দেশে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কুতর্ক করেন, তাঁরা কি এসব ইতিহাস জানেন না? জানলে স্বাধীনতার ঘোষণার ড্রাম তত্ত্ব, জিয়া কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা, আওয়ামী লীগ নেতারা জনগণকে ফেলে ভারতে আমোদ-ফুর্তিতে লিপ্ত ছিলেন ইত্যাদি কথা বলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতেন না। এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে যাঁরা এই ঐতিহাসিক দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক