মোহাম্মদ আলী
আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে যে বিষয়টিতে আমি নিজেকে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মনে করি তা হলো জাতির জনক, আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তার সান্নিধ্য লাভ করাটা যে কি বিরল সৌভাগ্য, কি মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা এবং অন্তরের গভীরে পরম শ্রদ্ধায় লালন করার মতো স্মৃতি তা যাদের সেই সৌভাগ্য হয়েছে তারাই শুধু অনুভব করতে পারেন। স্বাধীনতার পর আমার চাকরি জীবনের তিনটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল। তখন তার কিছু সিদ্ধান্ত, কিছু কথা এবং আমার প্রতি তার স্নেহশীলব্যবহার স্মরণ করে এখনো অভিভূত হই। তিনি যে কত বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন, ন্যায়বিচারের প্রতি তার যে কি শক্ত অবস্থান ছিল, আমাদের বাঙালি সমাজের পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি তিনি যে কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, বিশেষ করে এ দেশের গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষের প্রতি যে তার কি গভীর মমত্ববোধ ছিল এবং তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য, তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য তার যে কত আকুতি ছিল, এসবই ওই সময় যারা তার সচিবালয়ে তার আশপাশে ছিলেন তারা অবশ্যই উপলব্ধি করেছেন। তিনি যেমন একজন অতি উঁচু মাপের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন তেমনি ছিলেন অতুলনীয় মানবিক গুণাবলির অধিকারী একজন মহাপ্রাণ মানুষ। তার গুণাবলির অনেকগুলো বহিঃপ্রকাশ খুব কাছে থেকে লক্ষ্য করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা, কয়েকটি স্মৃতি আমি কখনো ভুলতে পারি না।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদ থেকে বদলি হয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) যোগদান করি। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। একদিন একটি ফাইল নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ হোসেনের সঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধুর কামরায় যাই। আমি তখন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং ও ডিসিপ্লিন ইত্যাদি বিষয়গুলোর দায়িত্বে ছিলাম। নথিটি ছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিবের বিরুদ্ধে গৃহীত শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার নিষ্পত্তি সংক্রান্ত। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জেনারেল ওসমানীর সুপারিশে এবং বিষয়টির ওপর তদন্ত না করেই ওই কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। বিস্তারিত তদন্তে দেখা গেল কর্মকর্তার কোনো দোষ নেই এবং তিনি নিরঙ্কুশ খালাস পাওয়ার যোগ্য। বঙ্গবন্ধু নথিটি দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘কিছুই পাওয়া যায়নি, তাহলে একটি ওয়ার্নিং দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করি’। সচিব ও অতিরিক্ত সচিব কিছু বললেন না। আমি তখন সাহস করে বললাম, ‘স্যার, মাফ করবেন, ওয়ার্নিংও একটি মাইনর পানিশমেন্ট। তার কোনো অপরাধ যেহেতু প্রমাণিত হয়নি তাকে কোনো শাস্তিই দেওয়া যাবে না, ওয়ার্নিংও নয়। তাকে অভিযোগ থেকে সসম্মানে অব্যাহতি দিতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু ফাইল থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন এবং পরে সৈয়দ হোসেন সাহেবের দিকে তাকালেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই আমার প্রথম দেখা, ভালো করে পরিচয় হয়নি। সৈয়দ হোসেন সাহেব পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি আমাদের মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। বঙ্গবন্ধু পুনরায় আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি কি সিএসপি?’ আমি বললাম ‘জি স্যার’। তিনি বললেন, ‘তুমি বলছ কোনো শাস্তিই দেওয়া যাবে না। ঠিক আছে তাহলে সসম্মানে খালাস দিলাম’। বলে তিনি নথিটি সই করে সংস্থাপন সচিবের হাতে দিলেন। কোনো শাস্তিই আপনি দিতে পারবেন না বলে হয়তো কিছুটা নার্ভাস হয়েছিলাম। কিন্তু না, বঙ্গবন্ধু একটুও রাগ করেননি বা বিরক্ত হননি। বরং মনে হলো একজন কর্মকর্তাকে শাস্তি দিতে হলো না এটি ভেবে একটু খুশিই হলেন। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ও মহান নেতা একজন জুনিয়র কর্মকর্তার বক্তব্য ধৈর্য সহকারে শোনা এবং তদানুসারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ঔদার্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি তার কমিটমেন্ট দেখে আমি সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই ঘটনা থেকে আমিও তার নজরে পড়ে গেলাম এবং তার একজন স্নেহধন্য কর্মকর্তায় পরিণত হলাম।
মে ১৯৭২ সালে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার নিয়োগের সরকারি আদেশ পেলাম। সৈয়দ হোসেন আমাকে ডেকে বললেন, ফরিদপুরের ডিসি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আপনাকে পছন্দ হয়েছে। তার ধারণা সেখানকার সমস্যাগুলো আপনি কিছু সমাধান করতে পারবেন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপদল ও নেতৃত্বের কোন্দল আপনি ভালো সামাল দিতে পারবেন। প্রসঙ্গত, তখন ফরিদপুর সদর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর (তখনো শরীয়তপুর আলাদা জেলা হয়নি) নিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা এবং সেই জেলায় শামসুদ্দিন মোল্লা, ওবায়দুর রহমান ও ইমামুদ্দিন সাহেবদের মধ্যে নেতৃত্বের ঠাণ্ডা লড়াই লেগে ছিল এবং দল তিনটি উপদলে বিভক্ত ছিল, যদিও তা তেমন প্রকাশ্য রূপ নেয়নি। আমি ফরিদপুর যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি বেইলি রোডের গণভবনে (বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমি) আমাকে দেখা করার সময় দিলেন। আমি দেখা করতে গেলে তিনি গণভবনের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে আমার সঙ্গে কথা বললেন। মনে পড়ছে তিনি ফরিদপুরের যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমাকে বললেন, দেখ তুমি ফরিদপুরের যোগাযোগের কিছু উন্নতি করতে পার কি না। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।
আমি দুই বছর (মে ১৯৭৩-মে ১৯৭৫) ফরিদপুরে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। চন্দনা-বারাসিয়া নদী খননকার্যের উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি ফরিদপুর গিয়েছিলেন, আবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন তার পিতা শেখ লুত্ফর রহমান সাহেবের মৃত্যুর পর। টুঙ্গিপাড়ার একদিন বিকালের কয়েকটি মুহূর্ত এখনো প্রায় প্রতিদিন আমার স্মৃতিতে ভাসে। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়িতে তার দাদার আমলের একটি দালান ছিল। সেটি তখন আর বসবাসের যোগ্য ছিল না। পরবর্তীতে একতলা একটি নতুন দালান হয়েছিল, খুব সম্ভব তার ছোট ভাই শেখ নাসের সাহেবের উদ্যোগে। বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়া গেলে সেই দালানের ছাদের ওপর গিয়ে মাঝেমধ্যে বসতেন। একদিন বিকালে তিনি ছাদে বসে আছেন। একমাত্র আমি তার সঙ্গে ছাদে তার পাশে বসা। তিনি টুঙ্গিপাড়া গেলেই আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষ তার কাছে আসত তার সঙ্গে দেখা করতে, অভাব-অভিযোগ জানাতে। সেদিনও আমরা দোতলার ছাদ থেকে দেখছিলাম অনেক মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসছে। মানুষের কারও পায়ে জুতা ছিল না, কারও কারও খালি গা। বঙ্গবন্ধু এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি যেন কোথাও হারিয়ে গেলেন। তার পাশে কেউ বসে আছে মনে হলো এই খেয়াল তার ছিল না। অনেকক্ষণ লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকলেন, ‘হে আল্লাহ, কবে এই লোকগুলোর গায়ের জামা হবে, পায়ে জুতা হবে, কবে আমি পারব এদের সব ব্যবস্থা করতে, এদের অবস্থার উন্নতি করতে, হে আল্লাহ’। তিনি স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো বলতে থাকলেন। এই দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য তার সেদিনের সেই আকুতি আমি স্বচক্ষে দেখেছি, তা কখনো ভুলব না। আমার মনে পড়ছিল বার্নার্ড শ’র নাটক ‘সেইন্ট জোয়ান’-এর একটি ব্যাকুল উচ্চারণ ‘O lord, how long, how long’!
এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ ও মমত্ববোধ, তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা ভেবে তার যন্ত্রণা এবং তাদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তার যে ব্যাকুলতা আমি লক্ষ্য করলাম তাতে অভিভূত না হয়ে পারিনি। আমি কিছু বলতে পারিনি, শুধু নির্বাক হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে বসেছিলাম। এত বছর পরও আমি চোখ বুজলেই চোখের সামনে সেই দৃশ্যটি দেখতে পাই।
আমি ফরিদপুরের ডিসি থাকাকালীন আর একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একসময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ফরিদপুরের সে সময়কার এসপির প্রতি বিরক্ত হন, তার সম্বন্ধে একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এসপির বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ এনে তাকে ফরিদপুর থেকে বদলির জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে জোর দাবি জানায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করে অভিযোগগুলো সঠিক কিনা জানতে চান। আমি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করি যে অভিযোগগুলো সঠিক নয়, ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অভিযোগগুলো এনেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে এসপিকে বদলি করা সমীচীন হবে না এই মর্মে আমি বঙ্গবন্ধুকে আমার মতামত জানাই। বঙ্গবন্ধু সব কিছু সঠিকভাবে বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবির ভিত্তিতে এসপির বিরুদ্ধে কোনোরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিরত থাকেন। নির্দোষ একজন কর্মকর্তা ন্যায়বিচার লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুর অন্তরটি একদিকে যেমন ছিল ফুলের মতো কোমল অন্যদিকে অন্যায়ের প্রতি ছিল কঠিন। ফরিদপুরের বালিয়াকান্দি থানার এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ও ফৌজদারি মামলা ছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে চেষ্টা করত না। থানার সামনে দিয়েই সেই লোকটা চলাফেরা করত। একবার সে রাজবাড়ীর এসডিওর সঙ্গে দেখা করতে যায়। তার ধারণা ছিল, সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসডিও আবদুর রউফ ছিলেন অত্যন্ত নির্ভীক একজন কর্মকর্তা। তিনি ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার জন্য কোর্ট ইন্সপেক্টরকে নির্দেশ দেন এবং একটি ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জেলহাজতে পাঠান এবং সেদিনই তিনি আমাকে ফোন করে ঘটনাটি জানান। আমি ভাবলাম ফৌজদারি মামলায় সে ঊর্ধ্বতন আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে যে কোনো সময় বাইরে চলে আসতে পারে। সেজন্য আমি তাকে Special Powers Act এর আওতায় ডিটেনশন আদেশ দিয়ে তার জামিনে মুক্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিলাম। সেই লোকটি ছিল আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম ওবায়দুর রহমান সাহেবের শাগরেদ। ওবায়দুর রহমান সাহেবের তদবিরের ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব। আমি ফরিদপুর থেকে তাকে ফোন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশটি সঙ্গত হয়নি বলে এটি প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ জানালাম। তিনি আমাকে ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দিলেন। আমি জানতাম ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে লাভ হবে না, তিনি আমার অনুরোধ নাও রাখতে পারেন। ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ফরিদপুরে একটি কর্মসূচি উদ্বোধন করতে আসার তারিখ ছিল। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশটি বাস্তবায়ন না করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। ফরিদপুর আসলে তার কর্মসূচির এক ফাঁকে কথাটা তার কাছে উত্থাপন করলাম এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে লোকটিকে মুক্তি দেওয়া সমীচীন হবে না বলে বঙ্গবন্ধুকে সবিনয়ে জানালাম। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবাদতুল্য। ওই লোকটিকে হয়তো ১০-১৫ বছর আগে দলের একজন মাঠপর্যায়ের কর্মী হিসেবে তিনি দেখেছেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ‘তুমি ওই... এর কথা বলছ? ওই যে মাথায় লম্বা বাবরি চুল? আমি বললাম ‘জি স্যার’। তিনি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, ‘ঠিক আছে, রাখ ওকে জেলে, ওর জেলে থাকাই উচিত। সে অনেক অপরাধ করেছে। আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের প্রভাবশালী একজন নেতা হলেও বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ বঙ্গবন্ধু বাতিল করে দিলেন, আমরা স্বস্তিবোধ করলাম। সেটি ১৯৭৪ সালের কথা। আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় ছিল লোকটি জেলেই ছিল। (জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় আসার পর যে পার্লামেন্ট গঠিত হয় আমি একদিন সেই পার্লামেন্টের সেশন দেখতে যাই। সেশন শেষ হলে সংসদ ভবনের বারান্দায় সেই লোকটির সঙ্গে আমার দেখা। কি ব্যাপার? তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন এবং এমপি হয়েছেন। আমাকে দেখে তিনি এগিয়ে এসে হাত মেলালেন এবং বললেন, ফরিদপুরের ডিসি হিসেবে আপনি আমাকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন মনে পড়ে, আমি এখন এমপি। তারপর আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বিদায় নিলেন। আমি কিছুদিন একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকলাম। লোকটি কি আমার বা রাজবাড়ীর তদানীন্তন এসডিও রউফ সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে? যাই হোক, অনেক দিন কেটে গেল, প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা সে করেনি। অপরাধীর সব সময় প্রতিশোধ নেওয়ার সাহস থাকে না।)
১৯৭৪ সালের সীমিত দুর্ভিক্ষের সময় দেখেছি বঙ্গবন্ধুর অস্থিরতা। প্রায় প্রতিদিন তিনি পরিস্থিতির খবরাখবর নিতেন এবং কোনো মানুষ যেন খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ না করে সে ব্যাপারে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসারে কাজ করে আমরা ফরিদপুরে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। ফরিদপুর থেকে বদলি হয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে যোগদান করি। বঙ্গবন্ধুকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। নতুন গণভবনে তার অফিস। প্রতিদিন এবং কোনো কোনো দিন একাধিকবার ফাইল নিয়ে অথবা কোনো জরুরি ব্যাপারে তার নির্দেশনা গ্রহণের জন্য তার অফিস কামরায় যেতে হতো। সে সময়ের কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ছে। ঘটনাগুলো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সেসব সামান্য ঘটনা থেকেই বঙ্গবন্ধুর সহূদয়তা, মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ ও বিশেষ দারিদ্র্য, অবহেলিত মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা, তার দরদ এবং আমাদের কতগুলো নৈতিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি কমিটমেন্ট— তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। একবার সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) থেকে একটি নথিতে প্রস্তাব আসে যে মিটফোর্ড হাসপাতালের একজন অবাঙালি জমাদার যে স্বাধীনতার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাকরিতে যোগদান না করে দুই দিন পর যোগদান করে তাকে চাকরিতে বহাল করা যাবে না যেহেতু সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যোগদান করেনি। বঙ্গবন্ধু নথিটি দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বল? আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘স্যার লোকটি গরিব, এদেশে তার থাকার ইচ্ছে না থাকলে সে জয়েনই করত না, তাকে চাকরিচ্যুত না করে দুই দিনের বিলম্বজনিত অপরাধ ক্ষমা করে দিন।’ বঙ্গবন্ধু তত্ক্ষণাত্ বললেন, ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমি তাকে চাকরিচ্যুত করব না, আমি একজন গরিব মানুষের চাকরি খেতে পারব না।’ লোকটি গরিব এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর নিকট বিবেচ্য বিষয়, সে বাঙালি না বিহারি তা তিনি মোটেই আমলে নেননি। এমনি ছিল গরিব মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ। বঙ্গবন্ধুকে দুটি ঘটনায় আমি ভীষণ রেগে যেতে দেখেছি। একবার খবর আসে যে খুলনায় সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চাল চুরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ভীষণ রেগে গেলেন, রাগে তিনি থরথর করে কাপতে থাকলেন, আমি তাকে কখনো এভাবে রাগতে দেখিনি। যে কোনো অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজ বঙ্গবন্ধুকে খুবই বিচলিত করত। তিনি অত্যন্ত কঠিনভাবে ও রাগতস্বরে অবিলম্বে এই চুরি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন।
পারিবারিক মূল্যবোধ, বৈবাহিক বন্ধন এই বিষয়গুলোকে বঙ্গবন্ধু খুব গুরুত্ব দিতেন। এসবের ব্যত্যয় দেখলে তিনি খুবই রেগে যেতেন। তার পরিচিত এক ভদ্রলোক তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এ খবর শুনে তিনি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন এবং বলতে লাগলেন যে, ওই বদমাশটাকে আমার সামনে ধরে নিয়ে এসো, আমি তাকে লাঠিপেটা করব। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের আর একটি সুন্দর দিক যা আমি লক্ষ্য করেছি তা হলো তার আশপাশের সবার প্রতি তার মায়ামমতা। এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বঙ্গবন্ধুর ঢাকার বাইরে সফরে যাওয়ার কথা। আমি তার একান্ত সচিব হিসেবে ভাবলাম যাওয়ার মুহূর্তে যদি তিনি কোনো কাজের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দিতে চান সেজন্য আমার সফরের পূর্বে তার সঙ্গে দেখা করা উচিত। আমি সকালেই ৩২ নম্বরে গেলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে পরম স্নেহে বললেন, তুমি কেন এসেছ? আমি বললাম স্যার ট্যুরে যাওয়ার আগে আপনার যদি কোনো নির্দেশ থাকে সেটা জানার জন্য। তিনি বললেন, ‘না, না, তুমি বাড়ি যাও, আজকে ছুটির দিন, তোমার তো কিছু পারিবারিক কাজও থাকতে পারে। ছুটির দিনে সেগুলো দেখ।’ বঙ্গবন্ধু আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। এমনি ছিল অধীনস্থ কর্মকর্তাদের প্রতি তার মমত্ববোধ ও বিবেচনা।
আর একটি ঘটনা। আমি ফরিদপুর থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় এসে সরকারি বাসা পাচ্ছিলাম না। পরিবারসহ থাকি আমার শ্বশুর বাড়িতে। আমার শ্বশুর ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ঢাকায় তার কোনো নিজস্ব বাড়ি ছিল না। কলাবাগানে একটি ভাড়া করা বাসায় থাকতেন। আমার বাসা সংক্রান্ত এই অসুবিধার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানানো সমীচীন মনে করিনি। কিন্তু কি আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধু ঠিকই খবর নিয়েছেন যে, আমি সরকারি বাসার বরাদ্দ পাচ্ছিলাম না। একদিন গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মইনুল হোসেন একটি নথি নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনের জন্য। আমি তখন তার কামরায় উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু কপট রাগ দেখিয়ে মইনুল হোসেন সাহেবকে বললেন, ‘আমি তোমার নথি সই করব না। আমার পিএস মোহাম্মদ আলী সরকারি বাসা পাচ্ছে না। তুমি আগে তাকে বাসা বরাদ্দ দেবে, তারপর তোমার নথি আমি সই করব।’ মইনুল হোসেন সাহেব বললেন— আমি দু-এক দিনের মধ্যেই মোহাম্মদ আলীকে বাসা বরাদ্দ দেব। পরদিনই আমি বাসা বরাদ্দ পাই। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমার বাসস্থান সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, বঙ্গবন্ধু আমার বাসস্থানের সমস্যা সমাধান করবেন। গণভবনের প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবার-পরিজনের সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের খবর তিনি রাখতেন। এমন সংবেদনশীল, স্নেহপ্রবণ, মহাপ্রাণ মানুষ এই পৃথিবীতে কমই এসেছে।
গণভবনে তার অফিস কামরার দরজাটি খোলাই থাকত। আমরা ফাইল নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে যদি দেখতাম বঙ্গবন্ধু ফ্রি আছেন তাহলে ফাইল নিয়ে তার সামনে যেতাম। একদিন আমি তার দরজায় গিয়ে দেখি তিনি এক দৃষ্টিতে তার কামরার দক্ষিণ দিকের খোলা জানালাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছেন আর কী যেন ভাবছেন। আমি ঢুকতে ইতস্তত করছিলাম। বেশ কতক্ষণ পর আমার দিকে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়ল। তিনি বললেন, ‘তুমি এসেছ, আস, আস।’ আমি কাছে গেলে তিনি বললেন, ‘আমি ফ্রি থাকলে তোমরা চলে এস, ইতস্তত কর না। আমি মাঝে মাঝে এমনি ভাবি, আজকেও ভাবছিলাম অনেক কিছু, দেশের কথা ভাবছিলাম, টুঙ্গিপাড়ার কথাও ভাবছিলাম।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে কেন জানি খুব বিমর্ষ ও আনমনা দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে তিনি তার স্বভাবসুলভ স্নেহশীল ব্যবহারই করলেন এবং আমার নথিগুলো সই করে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার অধঃস্তন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সব সময়ই খুব স্নেহশীল, সদয় ব্যবহার করতেন। জাতির জনক, আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীনতার স্থপতি, একজন বিশ্বনেতা, রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সচিবালয়ের একজন উপসচিবের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য এটা তিনি কখনো আমাদের বুঝতে দিতেন না। তার সামনে গিয়ে আমরা কখনো এ পার্থক্য অনুভব করিনি। আমরা সবাই নির্ভয়ে, স্বচ্ছন্দে তার সামনে গিয়েছি এবং তার সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলেছি। সব সময় তার কাছ থেকে সংবেদনশীল, স্নেহপ্রবণ ব্যবহারই পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর এসব বিরল মানবিক গুণাবলির কথা বলে শেষ করা যাবে না। কোটি কোটি বাঙালির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমি তাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।